ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত যেকোনো রোগ বা জ্বর, যেটাই হোক না কেন, আমাদের ঔষধের তালিকায় একটি ঔষধ সাধারণত থাকেই, তা হলো অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত রোগ উপশম করা বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত রোগ প্রতিরোধ করা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রধান কাজ হলেও, আমাদের দেহে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা এই অ্যান্টিবায়োটিকও প্রতিরোধ করতে পারে। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ডেনমার্কের এসোসিয়েট প্রফেসর ক্লেয়ার কির্কপ্যাট্রিক-এর নেতৃত্বে কর্মরত শিক্ষার্থীরা খুঁজে পেয়েছেন এমন কিছু ভাইরাস, যা কার্যকর এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া গুলোর বিরুদ্ধে।
COVID 19 চলাকালীন সময়ে সকল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজিতে অধ্যয়নরত এই শিক্ষার্থীরা ল্যাবে তাদের গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে পারে নি। কিন্তু তারা এটাকে বাধা হিসেবে তাদের গবেষণা বন্ধ করে নি। বরং ল্যাবে জীবাণু নিয়ে কাজ করার পরিবর্তে তারা তাদের আশেপাশের স্থানীয় মাঠে গিয়েছিলো গবেষণার জন্য অনুজীব ও জীবাণু খুঁজতে। এবং তখনি আশ্চর্যজনক ভাবে তারা শুধুমাত্র পরিচিত জীবাণুগুলোই নয়, বরং কিছু নতুন জীবাণু খুঁজে পায়।
এই খুঁজে পাওয়া জীবাণুগুলোর মধ্য থেকে তারা পাঁচটি নতুন প্রজাতির জীবাণু শনাক্ত করেছে। মাইক্রোবায়োলজি রিসোর্স আ্যনাউন্সমেন্টে বর্ণনা করা হয়েছে, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ডেনমার্কের গবেষণা দলটি খুঁজে পাওয়া পাঁচটি নতুন ভাইরাস প্রজাতির মধ্য থেকে একটি ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স ম্যাপ করতে পেরেছে। যার নাম দেয়া হয়েছে Fyn8।
ব্যাকটেরিওফাজ বা ফাজ কি?
পৃথিবীতে সবচেয়ে বিস্তৃত অনুজীব হলো ভাইরাস। জীব ও জড়ের মাঝামাঝিতে থাকা এই ভাইরাসগুলো এতটাই ছোটো যে খালি চোখে তাদেরকে দেখা যায় না। এগুলো সব ধরনের মাইক্রোবিয়াল চক্র এবং বাস্তুতন্ত্রের অংশ। এদের মধ্যে, যেসকল ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলতে পারে তাদের বলা হয় ব্যাকটেরিওফাজ বা ফাজ। Fyn8 ভাইরাসটিও একটি ব্যাকটেরিওফাজ যা Pseudomonas aeruginosa ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে মেরে ফেলতে পারে।
সিউডোমোনাস অ্যারুগিনোসা (Pseudomonas aeruginosa) কি?
সিউডোমোনাস অ্যারুগিনোসা (Pseudomonas aeruginosa) একটি ব্যাকটেরিয়া যা প্রাকৃতিক ভাবে মাটি এবং পানিতে পাওয়া যায়। এটি অন্যান্য অনেক ব্যাকটেরিয়ার মতো মিউটেশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত সুস্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়। তবে ক্ষত রোগীদের (যেমন পোড়া রোগী) এবং ভেন্টিলেটর রোগীদের জন্য ক্ষতিকর, যা অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে রোগীর রোগ নিরাময়ে বাঁধা দেয়।
গবেষকদের কোনো সন্দেহ নেই যে, এই Fyn8 ভাইরাসটি কার্যকর ভাবে Pseudomonas aeruginosa কে মেরে ফেলতে পারে।
এ সম্পর্কে গবেষক দলের তত্ত্বাবধানকারী, ক্লেয়ার কির্কপ্যাট্রিক, সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ডেনমার্ক, বলেন:
আমরা খালি চোখে দেখতে পেয়েছি, সিউডোমোনাস অ্যারুগিনোসা ব্যাকটেরিয়ার স্তরে পরিষ্কার গর্ত দেখা দিয়েছে, যেখানে Fyn8 ভাইরাসটি ব্যাকটেরিয়ার কোষগুলোকে সংক্রামিত করেছিলো, তাদের মেরে ফেলছিলো, নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলো এবং পরবর্তী আক্রমণ করতে এগিয়ে গিয়েছিলো।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই ব্যাকটেরিওফাজ কি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে?
ধারণা করা হচ্ছে বিশ্ব এমন একটি সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, যেখানে ক্যান্সারের চেয়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া-র সংক্রমণে বেশি মানুষ মারা যাবে। গবেষণায় জানা যায়, একটি ফাজ শুধু মাত্র একটি নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে। তবে আলাদা আলাদা রোগীর জন্য আলাদাভাবে নির্ভুল ঔষধ তৈরি করা এখন তুলনামূলক সহজ হবে। প্রথমে একজন রোগী ঠিক কোন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয়েছে তা বের করতে হবে। তারপর রোগীকে ঠিক সেই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যাকটেরিওফাজ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে যা ওই ব্যাকটেরিয়া কে মেরে ফেলবে।
জান্নাতুল ফেরদৌস/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স ডেইলি, ল্যাব-ইকুইপমেন্টস.কম