অটিজম! এইতো বছর দশেক আগেও এটি অনেকের কাছে অজানা একটি অভিশপ্ত রোগ হিসেবে পরিচিত ছিলো। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সকলেই জানে বা বোঝে যে, এটি আসলে অভিশাপ নয় বরং একটা রোগ। অটিজম মূলত একটি জন্মগত স্নায়ুবিক ত্রুটি, তবে এই ত্রুটিসম্পন্ন শিশুর রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেতে কমপক্ষে ৩-৪ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এই রোগ যত কম বয়সে নির্ণয় এবং এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, রোগীর সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা তত বেশি হয়। কাজেই আমাদের সবসময়ই সচেতন থাকা উচিত যে, কীভাবে আমরা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর রোগ লক্ষণ সহজে এবং আরোও আগে বুঝতে পারি! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের নতুন একটি গবেষণা অটিজম শণাক্তকরণ পদ্ধতিকে আরো ত্বরাণ্বিত করেছে!
এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে সান ডিয়েগোতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষকদের ‘আই ট্র্যাকিং টেস্ট’ নামের এক গবেষণা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ২ বছরের শিশুর উপর একটি সাধারণ পরীক্ষা পরিচালনা করেই জানতে পারবো শিশুটি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিনা!
গবেষণা পদ্ধতি:
এই গবেষণায় ৬৫৩ টি ১ থেকে ২ বছরের শিশুকে নেয়া হয় এবং প্রত্যেককে একই স্ক্রিনে ২ টি ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও দেখতে দেয়া হয়। একটি ভিডিওতে একজন নারী শিশুর প্রতি মাতৃসুলভ কথা বলতে থাকেন। আরেকটি ভিডিওতে এলোমেলো আকার-আকৃতি, নাম্বার ও ব্যস্ত হাইওয়ের দৃশ্য চলতে থাকে এবং বৈদ্যুতিক সুর বাজতে থাকে।
গবেষকেরা লক্ষ করেন, যে-সকল শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নয় তারা পুরো সময়ের প্রায় ৮২% সময়ই সেই ভিডিওর প্রতিই মনোযোগ ধরে রাখে, যে ভিডিওতে একজন নারী, শিশুর প্রতি মাতৃসুলভ কথা বলছিলেন। এছাড়াও দেখা যায়, তাদের এলোমেলো আকার-আকৃতি, নাম্বার ও ব্যস্ত হাইওয়ের দৃশ্যের ভিডিওর প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। উল্টোদিকে, দেখা যায়, যেসকল শিশুরা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তাদের কেউ পুরো সময় যে ভিডিওতে একজন নারী শিশুর প্রতি মাতৃসুলভ কথা বলছিলেন তার প্রতি মনোযোগ ধরে রাখে, আবার কেউ একেবারেই এর প্রতি নজর দেয়নি। এদের কেউ কেউ পুরোটা সময় ধরে এলোমেলো আকার-আকৃতি, নাম্বার ও ব্যস্ত হাইওয়ের দৃশ্য দেখতে থাকে। এইভাবে শিশুর অটিজম শণাক্তকরণ প্রক্রিয়া আরোও সহজ হবে।
‘আই ট্র্যাকিং টেস্ট’ গবেষণায় উঠে এসেছে, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সামাজিক ও ভাষাগত দক্ষতা কেমন হবে তা মাতৃসুলভ কথার প্রতি সাড়া দেয়ার প্রবণতার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। কিছু কিছু শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও মাতৃসুলভ কথার প্রতি অধিকাংশ সময়ই সাড়া দিয়েছিলো। গবেষকেরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে তারা উচ্চ সামাজিক ও ভাষাগত দক্ষতার অধিকারী হবে।
ইউসি সান ডিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিনের নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার অন্যতম সহযোগী কারেন পিয়ার্স (Karen Pierce) বলেছেন,
“মাতৃসুলভ কথার প্রতি শিশুর মনোযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা রোগীর সুস্থতায় কোন কোন চিকিৎসা কার্যকারী হবে তা বুঝতে পারবো।”
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে একজন মা কিভাবে তার সন্তানকে কথা বলা শেখান এবং শিশুর সাথে মায়ের মাতৃসুলভ কথা কিভাবে শিশুর মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে? উক্ত গবেষণায় উঠে এসেছে, শিশুর প্রতি মায়ের কথা শিশুর মনোযোগ এবং শিক্ষাকে উদ্দীপিত করে যা তার ভাষাগত দক্ষতা ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। মা সাধারণত শিশুর সাথে কখনো উচ্চ, কখনোবা নিম্নস্বরে কথা বলেন। কখনো ধিরে ধিরে, কখনো দ্রুত কথা বলেন। কথা বলতে মুখের নানা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন এবং একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করেন। এসবই শিশুকে ভাষা বুঝতে এবং প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
অটিজম বিষয়ে আমাদের যা যা জানা জরুরি:
অটিজম কী? অটিজম বা ASD (Autism Spectrum Disorder) হলো একটি জটিল স্নায়বিক বিকাশ সংক্রান্ত রোগ যা মানুষের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে এটি কিন্তু একটি জন্মগত ত্রুটি, কাজেই আমরা যেনো এ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যাক্তিকে কোনোভাবেই দোষারোপ না করি।
এ রোগের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- সামাজিক বিকলতা: অন্যান্যদের মতো সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে না পারা। কারো প্রতি আগ্রহ না থাকা, কে কী করছে, তা নিয়ে কৌতূহল না থাকা।
- কথা বলার প্রতিবন্ধকতা: এ রোগে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যাক্তি কখনো কখনো কিছু কথা শিখে থাকলেও সাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারে না। এমনকি তারা ইশারা-ইঙ্গিতও করতে পারেনা।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ: একই কাজ অনবরত করতে থাকে। শিশুরা একই খেলা বারবার খেলতে থাকে অথবা একটানা অপলক টিভিতে কার্টুন দেখতে থাকে।
এছাড়াও দেখা যায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। কোনো খেলনা বা আনন্দদায়ক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় না বা বিশেষ আচরণ বারবার করে। যেমন: বারবার হাত নাড়ানো, ভাষার ব্যবহার রপ্ত করার পর আবার ভুলে যাওয়া, কোনো বিশেষ বস্তুর প্রতি অতি মাত্রায় আসক্তি থাকা।
আরোও পড়ুন: অটিজম নিয়ে আমাদের ভুল ধারণাগুলো কী কী?
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর ব্যবস্থাপনা:
বাংলাদেশে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপে (২০২০-২১) বর্তমানে বাংলাদেশে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬১ হাজার। যদিও অটিজম ১০০% নিরাময় করা আজও সম্ভব হয়নি তবে সঠিক চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ৯০ থেকে ৯৫% নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা যায়। বাবা-মায়েরা তাদের শিশুর অটিজম শণাক্তকরণ করতে সম্ভব হলে তাদের উচিত শিশুটিকে দ্রুত থেরাপিস্ট, জেনেটিক এক্সপার্ট এবং কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যাওয়া।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে থাকে। জেনে রাখা ভালো অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মোৎজার্ট, বিল গেটসের মতো অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষও অটিজমে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিলেন। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুটি কিসে আগ্রহী তা বোঝা বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সুস্থ সদস্যদের দায়িত্ব। হয়তো সে ছবি আঁকতে, গণিত করতে অথবা কম্পিউটার চালাতে ভালোবাসে। ভালো লাগা বিষয়ের উপর দক্ষতা অর্জনে সহয়তা করে আমরা দেশের সকল অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সমাজে অন্যান্য শিশুর কাছাকাছি করে গড়ে তুলতে পারবো। এমনও হতে পারে তাদের মধ্য থেকেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জ্ঞানীগুণী মানুষগুলো উঠে আসবে!
আজম খান দীপ্ত/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Telegraph.co.uk, HealthNews.com
+1
+1
+1
+1
+1
+1
+1