মানুষসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণিরই আলোক-সংবেদনশীল অঙ্গ হলো চোখ। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অক্টোপাস এদের বাহুর মাধ্যমে অন্ধকারেও আলো অনুভব করতে পারে। আলোক সংস্পর্শে আসা মাত্রই অক্টোপাস তাদের বাহুগুলো দেহের দিকে টেনে নেয়। অন্ধকারে চোখে আলো দেখতে না পেয়েও বাহুর মাধ্যমে আলোক শনাক্তকরণ অক্টোপাসের এক অসাধারণ ক্ষমতা হিসেবেই পরিলক্ষিত হয়।
পৌরাণিক কাহিনীতে স্থান পাওয়া বিখ্যাত এক প্রাণীর নাম অক্টোপাস। কখনো “নরওয়ের ক্রাকেন” কখনো “আইনুদের আকোরোকামুই” কখনও বা “গ্রীসের গর্গন“। এরা মূলত সামুদ্রিক প্রাণী এবং এরা “আট” বাহুবিশিষ্ট। এরা “মলাস্কা” পর্বের প্রাণী এবং এদের প্রায় “১৫০ প্রজাতি” রয়েছে। অক্টোপাস মূলত ধীরগতিসম্পন্ন নিশাচর প্রাণী।
অক্টোপাস তাদের দেহাবস্থান সম্পর্কে দূর্বল বোধশক্তিসম্পন্নের ন্যায় আচরণ করে থাকে। তবে এদের বাহুর আলোক সংবেদনশীলতা নিকটস্থ শিকারীদের হাত থেকে এদেরকে রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
দীর্ঘদিন হতেই বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো অক্টোপাসের বাহুগুলো আলোক সংস্পর্শে প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে। অক্টোপাসের ত্বক “ক্রোমাটোফোর” নামক রঞ্জক পদার্থে পূর্ণ থাকে। এই “ক্রোমাটোফোর” অক্টোপাসের দেহের বর্ণ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। ক্যামোফ্লেজ (Camouflage) তাদের অন্যতম একটি ক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত হয়। অক্টোপাসের দেহের বর্ণ পরিবর্তনের ঘটনাকে ক্যামোফ্লেজ বলে।
Ruppin Academic Center এর তাল সম্রাট এবং নির নিশের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তারা হালকা আলোতে উক্ত ক্রোমাটোফোর এর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার লক্ষ্য করেন।
তারা বলেন, “টর্চ লাইটের অধিক উজ্জ্বল আলো বাহুতে প্রয়োগ করা মাত্রই সাথে সাথে এটি আচমকা বাহুটি সরিয়ে নিচ্ছিলো, যা ছিলো অত্যন্ত আশ্চর্যজনক”।
পরবর্তীতে নতুন এক পরীক্ষায় একটি “অস্বচ্ছ” ও “অন্ধকার” ট্যাংকে একটি অক্টোপাস রাখা হয়। ট্যাংকের শীর্ষের একটি ছোট গর্ত দ্বারা অক্টোপাসের একটি বাহুকে শিকার অব্দি পৌছানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিলো। অন্ধকারে শিকারের খোজেঁ ব্যস্ত থাকা অক্টোপাসের বাহুতে গবেষক দলটি বিভিন্ন সময় উজ্জ্বল আলো প্রয়োগে করে পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তারা লক্ষ্য করেছেন শতকরা ৮৪ ভাগ সময়েই অক্টোপাসটি তার বাহুটিকে সরিয়ে নিচ্ছে অর্থাৎ অন্ধকারে আলোক সংবেদনশীলতা প্রকাশ করছে। অন্ধকারে চোখ দ্বারা আলো শনাক্তকরণে ব্যর্থ হলেও বাহুর মাধ্যমে ঠিকই আলোর উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো অক্টোপাসটি।
নিশের বলেন, “আমরা প্রায়শয়ই তীব্র আলো থেকে তাপ অনুভব করি তবে অক্টোপাসের ক্ষেত্রে এরুপ ব্যাপার পরিলক্ষিত হয় না। বরং তাপমাত্রা পরিবর্তনে অক্টোপাসের উপর তেমন কোন প্রভাব নেই বললেই চলে”। এই আলোক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের পর তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো এই সংবেদনশীলতা কি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা জানার চেষ্টা করা। স্নায়ুকোষ নাকি মস্তিষ্ক? এ প্রশ্নের উত্তর খুজঁতে গিয়ে তারা নতুন এক পরীক্ষার মাধ্যমে অক্টোপাসের বাহুর “অধিক আলোক সংবেদনশীল” অঞ্চলটি শনাক্ত করেন। বাহুর বিভিন্ন অংশ আলোকজ্জ্বল করা হলে দেখা যায় বাহুর ডগায় অধিক সংবেদনশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পরবর্তীতে অচেতন (Anesthetized) অবস্থায় থাকা একটি অক্টোপাস নিয়ে তারা পরীক্ষা চালান। এর বাহুতে আলো প্রয়োগ করা হলে “ক্রোমাটোফোর” প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলেও বাহুগুলি টেনে নেয় না অক্টোপাসটি। এবারে বাহুর মাংসপেশী কেটে নেওয়ার পর সেখানে পুনরায় আলো প্রয়োগ করে পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাংসপেশী কেটে নেওয়া হলে বাহুর প্রতিক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় পেশী স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে বার্তা প্রেরণ করে এবং মস্তিষ্ক নির্দেশনা দেয় বাহুটি সরিয়ে নেবার জন্য।
তাল সম্রাট এবং নির নিশের কর্তৃক অপর একটি পরীক্ষায়ও একই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। তারা একটি মাছের উপর আলো প্রয়োগ করার ফলে অক্টোপাসটি মাছটি শিকার করা এড়িয়ে যাচ্ছিলো।
পর্তুগালের University of Lisbon এর এডুয়ার্দো সাম্পায়ো বলেন, “এটি মোটেও কোন প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়া নয়, বরং মস্তিষ্কের উচ্চ-স্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক ঘটনা যা সত্যিই অতুলনীয়”। তাল সম্রাট এবং নির নিশের এর চিন্তানুযায়ী এই প্রতিক্রিয়া অক্টোপাসকে আত্নরক্ষায় সাহায্য করে। তাল সম্রাট জানিয়েছেন, “এই আচরণ এতটা সুস্পষ্ট ও আকর্ষণীয়, যা পূর্বে কখনোই এভাবে প্রত্যক্ষ বা বর্ণনা করা হয়নি”। তাদের পরবর্তী ভাবনা হলো এই আচরণের উদ্দেশ্য ও এই আচরণের ফলে বিবর্তন (Evolution) সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটন করা।
তন্ময় ইসলাম তানভির/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Live Science