সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা অতীত দেখার জন্য একটি “কোয়াসার” কে মহাজাগতিক ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন এবং আবিষ্কার করেন যে একদম বিগ ব্যাং এর পরবর্তীকালের সময় বর্তমান সময়ের অপেক্ষায় ৫ গুন ধীরে চলতো!
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার সম্ভবত এটাই যে সময় ধ্রুব নয় বরং আপেক্ষিক। সময় বস্তুর গতির সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে, বর্তমান বিশ্বের সময় অর্থাৎ, বিগ ব্যাং এর প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পর সময় ৫ গুণ দ্রুত চলছে।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি ন্যাচার এস্ট্রোনমি নামক জার্নালে প্রকাশিত করেন ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি এর এস্ট্রোফিজিসিস্ট গেরেইন্ট লিউইস এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওকল্যান্ডের পরিসংখ্যান বিভাগের ব্রেন্ডন ব্রিওয়ার।
গেরেইন্ট লিউইস বলেন যে,
“দূরবর্তী মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের সময় মনে হয় যেন এর গতি ধীর হয়ে গেছে। ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয় যেন আমরা কোন স্লো মোশন মুভি দেখছি। অর্থাৎ, দূরবর্তী মহাবিশ্বে যাই হচ্ছে না কেন তা আপেক্ষিক ভাবে ধীর গতিতে হচ্ছে।”
গেরেইন্ট লিউইস আইনস্টাইনের ধারণাকে সত্য দাবি করে বলেন যে,
“আমরা যত দূরে দেখতে চাই সময় যেন তত ধীর হয়ে আসে। তাই বলা যায়, আইনস্টাইনের অনুমান সঠিক ছিল। ”
যেভাবে প্রমাণিত হলো সময়ের আপেক্ষিকতা:
১৯১৫ সালে আইন্সটাইন তার “থিওরি অফ জেনারেল রিলেটভিটি” তে এক চমকপ্রদ অনুমান করেন যে আদি মহাবিশ্বে শুধু মহাকাশই ভিন্ন ছিল না বরং সময়ও ভিন্নরূপে গতিপ্রাপ্ত ছিল। আদি মহাবিশ্ব বর্তমান থেকে অনেক বেশী উষ্ণ এবং ঘন ছিল এবং সময়ের প্রবাহ ছিল ধীর। পরবর্তীতে মহাবিশ্বের আকার ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাওয়াতে মহাবিশ্ব ঠান্ডা এবং ঘনত্ব কমতে শুরু করলো যার ফলে সময় আরো দ্রুত চলতে লাগলো।
“থিওরি অফ জেনারেল রিলেটিভিটি” তে বলা হয়েছে যে মহাবিশ্বের ৩ মাত্রা (দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা) এবং সময়ের এক মাত্রা মিলে ৪র্থ মাত্রা তৈরী করে যা “স্পেসটাইম” নামে পরিচিত।
যখন কোন ভরযুক্ত বস্তুকে এই স্পেসটাইমের উপর রাখা হয় তখন এটি স্পেস ফেব্রিকে বিকৃতি বা বাঁক সৃষ্টির মাধ্যমে স্পেস ফেব্রিকের ৪র্থ মাত্রায় গর্ত তৈরী করে।
বুঝার সুবিধার্থে একটি টানটান করে ধরে রাখা কাপড়কে কল্পনা করতে পারেন। কাপড়ের মাঝখানে যত ভারী বস্তু স্থাপন করা হবে কাপড়টিতে ঠিক তত গভীর গর্ত সৃষ্টি হবে।
স্পেস টাইমের এই বাঁকই নির্ধারণ করে দেয় কোনো ভারী বস্তুর (ব্ল্যাকহোল, নক্ষত্র, গ্রহ) এর নিকট সময় কত দ্রুত অথবা ধীরে চলবে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে আদি মহাবিশ্বেও সময় প্রসারণ এর উপস্থিতি ছিল।
লিউইস, সময় প্রসারণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে,
“মহাবিশ্বের সম্প্রসারণই সময় প্রসারণের একমাত্র কারণ। ডার্ক ম্যাটার অথবা ডার্ক এনার্জির কোন ভূমিকা এর পিছনে নেই।”
একজন টাইম ট্রাভেলার এর জন্য সময় প্রসারণ কেমন হবে?
সময় পরিভ্রমণ সম্ভবত সবচেয়ে আনন্দদায়ক এবং উত্তেজনায় পরিপূর্ণ বিজ্ঞানের শাখা। সময় পরিভ্রমণ নিয়ে এই পর্যন্ত অসংখ্য বই, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু যত যাই হোক, চলচ্চিত্রে বিজ্ঞানের পাশাপাশি কল্পনারও ছোঁয়া থাকে যার ফলে বিজ্ঞানের আসল স্বাদ এবং জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয় পাঠক এবং দর্শকরা।
চলুন জেনে নেয়া যাক মহাজাগতিক ঘড়ি-তে একজন টাইম ট্রাভেলার এর সময় প্রসারণ এর অভিজ্ঞতা কেমন হবে।
বর্তমানের শক্তিশালী টেলিস্কোপ এর মাধ্যমে প্রায় ১২.৩ বিলিয়ন বছর আগের প্রাচীন কোয়াসার এর আলো পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে সহজেই অতীত দেখা যায় এবং সময় প্রসারণ সম্পর্কে জানা যায়।
কিন্তু একজন মানুষ নিজে স্ব-শরীরে কিভাবে অতীত ভ্রমণের মাধ্যমে সময়ের প্রবাহ দেখতে পারবে?
সময় পরিভ্রমণ শুধু তখনই বুঝা সম্ভব যখন টাইম ট্রাভেলার এর ঘড়ির সাথে বর্তমান পৃথিবীতে থাকা ঘড়ির তুলনা করা হবে।
কোন সময় পরিভ্রামক যদি আলোর কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করে তবে সময় পৃথিবীর সাপেক্ষে তার জন্য ধীরে চলবে। কিন্ত তার সাপেক্ষে পৃথিবীতে সময় দ্রুত চলবে।
অর্থাৎ কোন মহাকাশচারী যদি আলোর ০.৮ গুন বেগে মহাকাশে ভ্রমণ করেন তবে তার কাটানো প্রতি ১ সেকেন্ডের জন্য পৃথিবী তে ১.৬৭ সেকেন্ড কেটে যাবে। এ থেকে বলা যায় যে সেই মহাকাশচারীই যদি মহাকাশে একই বেগে ২০ বছর অতিবাহিত করে তবে পৃথিবীতে ৩৩.৪ বছর কেটে যাবে।
২০ বছর × ১.৬৭ ≈ ৩৩.৪ বছর
এ থেকেই বুঝা যায় যে সময় পরিভ্রমণ প্রমাণিত এবং সময় প্রসারণ সম্ভব।
লিউইস তার গবেষণা নিয়ে বলেন যে,
“আমরা আমাদের সময় পরিভ্রমণ এবং প্রসারণ বিষয়ক তত্ত্ব আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে চাই। তাই আমাদের আবার শতাব্দী পুরনো গবেষণা এবং তত্ত্ব আবার নতুন করে লিখতে হবে না এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক।”