বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত তার গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। বিজ্ঞানের এই সকল নতুন আবিষ্কার আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরো সহজ করে তোলে। পাশাপাশি এটি আমাদের চিন্তা শক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। ২০২৪ এমন একটি বছর যেখানে বিজ্ঞান উদ্ভাবনীতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। তাদের এসব নতুন উদ্ভাবন আমাদের সামনে ভবিষ্যতের এক অপার সম্ভাবনাময় দ্বার উন্মোচন করে। ২০২৪ সালের নতুন কিছু উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রা আরও উন্নত এবং টেকসই করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই বছর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও উদ্ভাবন গুলোর মাধ্যমে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আশা করা যাচ্ছে।
চলুন জেনে আসি ২০২৪ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ১৫টি উদ্ভাবন সম্পর্কে:
১) ইনসুলিন গ্রহণের নতুন পদ্ধতি, যা ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাতে পারে
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস একটি অত্যন্ত গুরুতর রোগ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী শতকরা প্রায় ১০% মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য বাহ্যিকভাবে ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়। প্রচলিত ইনসুলিন থেরাপি ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়, যা অনেকের জন্য অসুবিধাজনক। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির (NYU) গবেষকরা একটি নতুন জৈব ন্যানোপার্টিকেল প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা সরাসরি মুখ দিয়ে ইনসুলিন গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। এই ন্যানোপার্টিকেল গুলো উচ্চ ইনসুলিন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন, অ্যাসিডিক প্রতিরোধী এবং কোনো বিষক্রিয়া ছাড়াই অন্ত্রের মধ্য দিয়ে যেতে সক্ষম। টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য এটি আরও সুবিধাজনক ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত চিকিৎসা প্রদান করতে পারে।
২) নিউক্লিক অ্যাসিড থেরাপিউটিকস
বিভিন্ন জিনগত রোগ, সংক্রামক রোগ এবং ক্যান্সারের চিকিৎসায় নিউক্লিক অ্যাসিড থেরাপি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, কিন্তু এগুলো শরীরে প্রয়োগ করা বেশ জটিল একটি বিষয়। কারণ নিউক্লিক অ্যাসিড খুবই চার্জযুক্ত এবং সহজে নষ্ট হয়ে যায়। তাই একটি উপযুক্ত ডেলিভারি সিস্টেম দরকার যা এগুলোকে নিরাপদে শরীরে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে পলিমার ন্যানোপার্টিকেল একটি ভালো সমাধান হতে পারে। এই ন্যানোপার্টিকেলগুলোর ভেতরে নিউক্লিক অ্যাসিড রাখা হয়, যা শরীরে সহজে ও নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করতে পারে। এর মাধ্যমে জিন থেরাপি, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য চিকিৎসার উন্নতি হতে পারে।
৩) ইভি এ ব্যবহৃত লিথিয়াম ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই পরিবর্তন
নতুন সমাধান নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করে। ইভি বা ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি করছে। এ সমস্যার সমাধানে, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি নতুন প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যা নিরাপদ রাসায়নিক কেমিক্যাল এবং পানি ব্যবহার করে ব্যাটারি উপাদানগুলো আলাদা করতে সক্ষম। এই পদ্ধতি দ্রুত, সাশ্রয়ী এবং বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য, যা রিসাইক্লিংয়ের বর্জ্য কমিয়ে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং আরও কার্যকরভাবে প্রক্রিয়া করতে সক্ষম হবে।
৪) আপসাইক্লিং– উচ্চ পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার
প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন পলিইথিলিন (PE), পলিপ্রোপাইলিন (PP), এবং পলিভিনাইল ক্লোরাইড (PVC) উৎপাদিত হয়। তবে PVC পুনর্ব্যবহার করা কঠিন, কারণ এতে খরচসাপেক্ষ প্রক্রিয়া ও ক্ষতিকারক উপজাত তৈরি হয়।
ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা একটি নতুন নিম্ন-তাপমাত্রার রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যা PVC বর্জ্যকে উচ্চ-ঘনত্বের PE এবং PE মোমে রূপান্তর করতে পারে। এই প্রক্রিয়া ক্লোরিন অপসারণ করে বিপজ্জনক যৌগকে লবণে রূপান্তর করে, ফলে এটি পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক সমাধান হয়ে উঠেছে।
৫) কংক্রিট: সিমেন্টের একটি টেকসই বিকল্প
বর্তমানে অট্টালিকা বা ভবন নির্মাণে সিমেন্ট একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। কিন্তু সিমেন্ট তৈরিতে উচ্চ শক্তির প্রয়োজন এবং কার্বন নির্গমনে অনেক অবদান রাখে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই সমস্যা সমাধানে কোলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা কর্ণ বায়োমাস ব্যবহার করে সিমেন্টের একটি বিকল্প তৈরি করেছেন। এটি সিমেন্টের চেয়ে বেশি টেকসই এবং শক্তিশালী, ব্লকগুলোর চিরে যাওয়া এবং টেনসাইল স্ট্রেসের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এই প্রযুক্তি আমাদের পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
৬) পারকিনসন রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বিপ্লবী প্রযুক্তির উদ্ভাবন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা একটি বিপ্লবী পদ্ধতি alpha-synuclein seed amplification assey (alphaSyn-SAA) উদ্ভাবন করেছেন, পেন্সিল্ভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু সিডারুফ এই গবেষণায় সহ-নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই প্রযুক্তি লক্ষণ প্রকাশের আগেই পারকিনসন রোগ শনাক্ত করতে পারে।
পারকিনসন রোগ নির্ণয় করা কঠিন, কারণ এর কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই এবং এর লক্ষণগুলো অন্যান্য রোগের সাথে মিলে যায়, যার ফলে প্রায়ই ভুল নির্ণয় হয়।এই পদ্ধতি পারকিনসন্স রোগের সাথে সম্পর্কিত অস্বাভাবিক প্রোটিনের বৃদ্ধি শনাক্ত করে, যা প্রাথমিক এবং নির্ভুলভাবে শনাক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি করে।
প্রাথমিক নির্ণয়, রোগীদের যার যার ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করতে পারে, রোগীর স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে এবং একটি প্রতিষেধক খুঁজে বের করার জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ত্বরান্বিত করতে পারে। গত ২৫ বছরে পারকিনসন রোগের প্রাদুর্ভাব দ্বিগুণ হয়েছে এবং বর্তমানে এটি ১ কোটিরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করছে।
অধ্যাপক অ্যান্ড্রু সিডারুফ বলেছেন, “এটি বায়োমার্কার চিকিৎসার কৌশল বদলে দিতে পারে।” ল্যানসেট নিউরোলজি জার্নালে প্রকাশিত এই আবিষ্কার লক্ষ লক্ষ রোগীর জন্য আশা তৈরি করেছে এবং পারকিনসন্স রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে।
৭) এক নতুন CAR-T থেরাপি যা টিউমারের মেটাস্টেসিস থামায়
যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর প্রায় ৫৫,৯০০ নতুন স্তন ক্যানসারের ঘটনা দেখা যায়, এবং মেটাস্টেসিস (ক্যানসার কোষের শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া) এর ফলে এই ক্যানসার এর ফলে মৃত্যু হয় সবচেয়ে বেশি। ইনস্টিটিউট অফ ক্যানসার রিসার্চ-এর বিজ্ঞানীরা “এন্ডোসিয়ালিন” নামক একটি প্রোটিন শনাক্ত করেছেন, যা একটি ট্রান্সমেমব্রেন রিসেপ্টর। এটি সাধারণ টিস্যুতে খুবই সীমিত পরিমাণে প্রকাশ পায়, তবে টিউমারের মেটাস্টেসিসকে শক্তিশালীভাবে বাড়ায়।
গবেষকরা এন্ডোসিয়ালিন-যুক্ত CAR-T কোষ তৈরি করে তা স্তন ক্যানসারের একটি মাউস মডেলে পরীক্ষা করেছেন। এই থেরাপি প্রধান টিউমারের বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে এবং টিউমার টিস্যুতে ক্যান্সার কোষের মৃত্যু ঘটিয়েছে, তবে স্বাভাবিক টিস্যুকে কোনো ক্ষতি করেনি। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, এন্ডোসিয়ালিন-নির্দেশিত CAR-T থেরাপি শুধু মেটাস্টেটিক স্তন ক্যানসার নয়, অন্যান্য টিউমার এবং মেটাস্টেটিক ক্যানসারের চিকিৎসার জন্যও কার্যকর হতে পারে।
৮) ফাইব্রোটিক রোগের চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে একটি হিউম্যানাইজড অ্যান্টিবডি
ফাইব্রোটিক রোগ এমন একটি রোগ যা অতিরিক্ত কোলাজেন উৎপাদনের ফলে দাগযুক্ত টিস্যু তৈরি হয়, যা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। এর বেড়ে উঠার ধরণ এবং কার্যকর চিকিৎসার অভাবে এটি জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কোলাজেন মানবদেহে প্রোটিন এর ঘনত্ব, হাড়, টেন্ডন এবং অঙ্গের শক্তি ও গঠন বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এর অসামঞ্জস্য উৎপাদন বিকলঙ্গ-এর মতো প্রাণঘাতী সমস্যার কারণ হতে পারে।
টমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই সমস্যার সমাধান হিসেবে একটি হিউম্যানাইজড পেটেন্ট করা অ্যান্টিবডি তৈরি করেছেন। এই অ্যান্টিবডি কোলাজেন অণুগুলোকে অদ্রবণীয় তন্তুতে জমাট বাঁধা থেকে প্রতিরোধ করে, ফলে প্যাথলজিক্যাল ফাইব্রোসিস বন্ধ করে দেয়। এটি পরীক্ষামূলক মডেলে ফাইব্রোটিক রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, তবে সুস্থ কোলাজেনের গঠনে কোনো ক্ষতি করেনি।
এটি বিভিন্ন ধরনের ফাইব্রোটিক সমস্যার চিকিৎসায় আশার আলো দেখাচ্ছে। গবেষক দল এই বিপ্লবী সমাধানটিকে ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন লাইসেন্সিং পার্টনার খুঁজছে।
৯) খাদ্য সংরক্ষণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে পরিবেশবান্ধব বায়ো-বেসড প্যাকেজিং
ভেনিসের কা’ফোসকারি ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এমন একটি নতুন বায়ো-বেসড প্যাকেজিং তৈরি করেছেন, যা পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি খাবারের গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। এই প্যাকেজিংয়ে একটি অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল যৌগ ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্যাকেটের উপাদানের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত থাকে। এর ফলে এটি খাবারে কোনো প্রভাব না ফেলেই ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি রোধ করে এবং খাবারের ব্যবহারযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয় আর দ্রুত পচনশীলতা রোধ করে।
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ এবং খাদ্যের পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে এটি সহায়তা করবে। সাধারণ প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের তুলনায় এই প্রযুক্তি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায়, এটি প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে। সেই সাথে এটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। এই প্রযুক্তি শুধু টেকসই প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বরং খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চলেছে।
১০) প্রাকৃতিক উৎস থেকে মিষ্টির উৎপাদন, যা কমাবে স্থূলতা
মিষ্টি খাবার তৈরিতে সাধারণত সুইটেনার ব্যবহার করা হয়, কারণ এটি ক্যালোরি কমায় এবং স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে অনেকেই সুইটেনার পছন্দ করেন না, কারণ এগুলোতে স্বাদ অস্বাভাবিক লাগে বা অনেকেই মনে করেন এটি আসক্তি তৈরি করতে পারে।
“ব্রাজেইন” নামে একটি প্রাকৃতিক প্রোটিন, যা পশ্চিম আফ্রিকার ওউব্লি গাছের ফল থেকে পাওয়া যায়, যা শত শত বছর ধরে মিষ্টি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি চিনি মতো মিষ্টি, উচ্চ তাপমাত্রায় নষ্ট হয় না, এবং অনেক দিন স্থায়ী হয়। এ কারণে এটি খাবার তৈরির জন্য উপযুক্ত। তবে এতদিন পর্যন্ত বড় পরিমাণে এটি উৎপাদন করা খুবই ব্যয়বহুল ছিল।
ইউনিভার্সিটি অফ ওউলুর গবেষকরা এই সমস্যার সমাধান বের করেছেন। তারা একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যা সহজ, সস্তা এবং বড় আকারে ব্রাজেইন উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। এই পদ্ধতিতে এমন সব সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রায় প্রতিটি রান্নাঘরেই পাওয়া যায়। এর ফলে, এখন খাদ্য শিল্পে কম ক্যালরিযুক্ত এবং চিনির স্বাদের একটি সাশ্রয়ী বিকল্প পাওয়া যাবে। এই উদ্ভাবন সুস্বাদু খাবার তৈরির ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। পাশাপাশি, যে সব মানুষরা স্বাস্থ্য সচেতন বা ডায়েট মেনে চলে তারাও অতিরিক্ত ক্যালোরির চিন্তা ছাড়াই এটি গ্রহণ করতে পারবে।
১১) গ্লুকোমার চিকিৎসায় নতুন মাইলফলক
গ্লুকোমা একটি গুরুতর চোখের সমস্যা যা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়। বর্তমানে বিদ্যমান চিকিৎসা গুলো যেমন: ড্রপ প্রয়োগ করার জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তি প্রয়োজন হয়। কারণ স্ব-চিকিৎসার প্রয়োগ রোগীর জন্য কঠিন।
এই সমস্যা সমাধানে জর্জিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির একদল বিজ্ঞানী গ্লুকোমার থেরাপিউটিক এজেন্ট গুলোকে চোখের সাবকনজাকটিবাল অংশে পৌঁছে দিতে পারে এমন একটি ডিভাইস তৈরি করেছে। যা গ্লুকোমা থেরাপিউটিক চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। ডিভাইসটি আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে নিজেই ব্যবহার করতে পারে। যা নিরাপদ এবং ব্যবহারকারী বান্ধব হওয়ায় পেসক্রিপশনের নির্দেশনা বজায় রাখা যায়।
১২) নবায়নযোগ্য শক্তির সংরক্ষণ সমস্যার সমাধান
নবায়নযোগ্য শক্তির সংরক্ষণ বর্তমান বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, নবায়নযোগ্য শক্তি সমূহ যেমন: সৌর এবং বায়ু নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না। এই শক্তিগুলোর উৎপাদন নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর, যা প্রকৃতিগতভাবেই পরিবর্তনশীল। শক্তি সংরক্ষণ প্রযুক্তি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করার সক্ষমতা কার্যকরভাবে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। যা পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়তা করে।
সঠিক স্টোরেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে। এই বছর এনার্জি স্টোরেজের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো দেখা দিত তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। যেমন:
- ব্যাটারি প্রযুক্তি: ব্যাটারির দক্ষতা এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
- স্মার্ট গ্রিডের ব্যাপক ব্যবহার: স্মার্ট গ্রিড যা বিভিন্ন সেন্সর, কম্পিউটার এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে ব্যবহার পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রম সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ২০২৪ স্মার্ট গ্রিডের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
- কম্প্রেসড এয়ার, গ্রাভিটি এবং থার্মাল এনার্জি স্টোরেজ: উক্ত স্টোরেজ ব্যবস্থা যদিও বহু পুরোনো প্রযুক্তি তবে এই প্রযুক্তি সমূহের উল্লেখযোগ্য সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়েছে নতুন গবেষণায়। কম্প্রেসড এয়ার এনার্জি স্টোরেজ হলো, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাতাসকে কম্প্রেস করে সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে তা মুক্ত করে শক্তি উৎপাদন করা। গ্রাভিটি এনার্জি স্টোরেজ হলো, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কোনো বস্তুকে উপরে তুলে তা গ্রাভিটির সাহায্যে নিচে নামিয়ে শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা। তেমনি থার্মাল এনার্জি স্টোরেজ হলো, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কোনো পদার্থকে উত্তপ্ত করে তরল বা বাষ্পে পরিণত করা এবং প্রয়োজনে এই বাষ্প থেকে টারবাইন ঘুরিয়ে শক্তি উৎপাদন করা।
১৩) এইচআইভি প্রতিরোধক ঔষধের আবিষ্কার
২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সহ বিভিন্ন সংস্থা এইচআইভি প্রতিরোধক ঔষধ লেনাকাপাভির (Lenocapavir) অনুমোদন দেয়। ২০২৪ সালে, লেনাকাপাভিরের নির্মাতা গিলিয়াড সায়েন্সের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দুটি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, একটি পরীক্ষায় ঔষধটির ৯৬ শতাংশ এবং অন্য পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ সাফল্য লাভ করেছে।
লেনাকাপাভির কে প্রি-এক্সপোজার প্রফিল্যাক্সিস (PrEP) হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যা বছরে দুবার প্রয়োগ করা যাবে।
লেনাকাপাভির এইচআইভির ক্যাপসিড প্রোটিনকে লক্ষ্য করে একে ধ্বংস করে দেয়। জার্নাল সায়েন্স এটিকে ২০২৪ সালের ‘Breakthrough of the year’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
১৪) অস্ট্রেলিয়ান বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এর কৃত্রিম হার্ট আবিষ্কার
অস্ট্রেলিয়ান বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড্যানিয়েল টিমস কার্ডিয়াক কেয়ারে বিপ্লব আনার চেষ্টা করেছেন। টিমসের কোম্পানি BiVacor একটি কৃত্রিম হার্ট তৈরি করেন যা বাস্তব হার্ট এর মতো পুরো শরীরে রক্ত প্রবাহিত করতে পারে।
চলমান সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অংশ হিসেবে, এই বছর তিনজন মার্কিন রোগীকে ডোনার অঙ্গ না পাওয়া পর্যন্ত এই কৃত্রিম হার্ট বাঁচিয়ে রেখেছিল। যদি স্বল্প মেয়াদি এই ট্রায়াল সম্পূর্ণ হয়, তবে BiVacor হার্টটি অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ করবে কি না তা পরীক্ষা করবে। যা সম্ভবত জীবিত অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করবে এবং এ পরীক্ষা সম্পূর্ণ সফল হলে এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর মাইলফলক হয়ে থাকবে।
১৫) তাপ প্রতিফলিত কোটিংয়ের বিশাল মাইলফলক অর্জন
তাপ প্রতিফলিত কোটিং গুলো বিশ্বব্যাপী এনার্জি ম্যানেজমেন্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এগুলো সাধারণত বিষাক্ত এবং ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। এর সমাধানের জন্য, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আরভিনের গবেষকরা প্রাকৃতিক উৎস যেমন: সস্তা বায়োমলিকিউল থেকে প্রাপ্ত একটি ইনোভেটিভ এনার্জি ইফিশিয়েন্ট কোটিং তৈরি করেছেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব কম খরচে অনেক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব। যা সম্পূর্ণরূপে বায়োকম্প্যাটিবল। নতুন এই কোটিং ভোক্তা এবং প্রতিষ্ঠানের এনার্জি ব্যয় কমাতে কার্যকরী। তাদের এই অর্জন ক্রীড়া সরঞ্জাম, পোশাক এবং ক্যাম্পিং সরঞ্জামের মতো বস্তুগুলোর জন্য সাশ্রয়ী ও বায়োকম্প্যাটিবল।
২০২৪ সাল বিজ্ঞানের দিগন্তে এক নতুন আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই বছরের উদ্ভাবনগুলো কেবল আমাদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করেনি, বরং মানবতার অগ্রযাত্রায় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, জটিল রোগের নিরাময়, খাদ্য সংরক্ষণ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার বিভিন্ন উদ্ভাবন আমাদের সামনে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং উদ্ভাবনী মনোভাবের ফলেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সমন্বয়ে আমরা একটি টেকসই এবং স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি। বিজ্ঞানের এই ধারাবাহিক অগ্রগতি আগামী দিনগুলোতে আমাদের জীবনকে আরও সহজ, নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলবে।
সজিবুল আলম ভূইয়া, নিশাত আনজুম, সুমাইয়া বিনতে সেলিম /যৌথ প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ইনপার্ট.আইও, টাইম.কম, ডিস্কোভার.কম