বলেছিলেন স্রেফ হাত ধুতে। বলেছিলেন, প্রসূতিদের পরীক্ষার আগে ভাল করে হাত ধুতে হবে। যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, সে সবও ধুতে হবে। আর সেই ‘অপরাধ’-এ পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছিল এক চিকিৎসককে!
তিনি হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ। হাত ধুতে শিখিয়েছিলেন বলে যাঁকে পাগল আখ্যা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল মানসিক হাসপাতালে।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। সাধারণের চেয়ে তিনগুণ বেশি প্রসূতি মারা যেতেন। চাইল্ড বেড ফিভার নামের এক ধরণের সমস্যায় ভরা ছিল তখন। স্যামেলওয়াইজ লক্ষ্য করলেন এর কারণ অপরিচ্ছন্নতা। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকদের তিনি নির্দেশ দিলেন, গর্ভবতী মহিলাদের পরীক্ষা করার আগে হাত ভাল করে ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেগুলোও ধুয়ে নিতে হবে। সে সময় ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও তারা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন চিকিৎসকরা। পরে দেখা গেল, শুধু এটুকুতেই মৃত্যুর হার প্রায় ৯৯ শতাংশ কমে গিয়েছে। পুরো বছরে একজনও হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করলেন না।
স্যামেলওয়াইজ খুশি হয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পরিচ্ছন্নতার কথা বলতে ও লিখতে শুরু করলেন। তবে জীবাণু সম্বন্ধে ধারণা না থাকায় সে কারণ বলতে পারেন নি তিনি। তবে নানা রকম পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন তিনি।
এরপরও ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা বেঁকে বসলেন। তবে কি রোগী মারা যাওয়ার জন্য ডাক্তারদের দোষারোপ করছেন স্যামেলওয়াইজ? এবার বেঁকে বসলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
হাঙ্গেরিতে নিজের ঘরে ফিরে এলেন স্যামেলওয়াইজ। অনেক ভাবলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করলেন কিছু। তারপর ১৮৬১ সালে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করলেন গবেষণামূলক প্রবন্ধ। তাতে তিনি জানালেন, টয়লেট থেকে এসে, ছোটখাটো অপারেশন বা রোগীকে পরীক্ষা করার সময় ডাক্তারদের উচিত হাত ভালো করে ধুয়ে নেওয়া।
করোনা আপডেট |
কারণ একবার নয়, বহুবার তিনি দেখেছেন, মর্গ থেকে এসে ডাক্তাররা যখন রোগী দেখেন তখন মৃতদেহ থেকে ভয়ঙ্কর কিছু উপাদান রোগীর মধ্যে চলে আসে। তাতেই অনেকে মারা যান। লাভ হল না। ডাক্তাররা তো বটেই, বিজ্ঞানের অন্য শাখার মানুষরাও তখন বিশ্বাস করতেন যে রোগ-শোক-মৃত্যু, সবের মূলেই রয়েছে দুষ্ট আত্মা। মানুষের সাধ্য নেই তাকে অতিক্রম করে। স্যামেলওয়াইজ পাগলের প্রলাপ বকছেন। এমনকি, তার স্ত্রীও ভাবতে শুরু করলেন তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। না হলে এ সব কেউ বলে!
এবার ধরে ধরে সব চিকিৎসককে চিঠি পাঠাতে শুরু করলেন স্যামেলওয়াইজ। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের অনুরোধ করলেন, যেন তারা হাত ধুয়ে, যন্ত্রপাতি ধুয়ে তবে রোগী পরীক্ষা করেন, অপারেশন করেন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর এটাই এক বড় রাস্তা। আর সব জেনেও যদি তারা তা না করেন, ধরে নিতে হবে তারা অজান্তে মানুষ খুন করার মতো অপরাধ করছেন।
পরিস্থিতি চরমে উঠল। সবাই মিলে পাগল বলে দেগে দিলেন তাকে। চরম হতাশা থেকে গ্রাস করল অবসাদ। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার পর তাকে পাঠানো হল মানসিক হাসপাতালে। সবার অবজ্ঞাই যে তাকে এই অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে, তা কেউ বুঝলেন না। বললেন না। বরং বললেন তার ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, কেউ বললেন ভর করেছে আত্মা।
হাসপাতালে চিকিৎসা হওয়া দূরস্থান, শুরু হল মারধর। ১৪ দিনের মাথায় মারের চোটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেন তিনি। কোনও চিকিৎসার সুযোগ পেলেন না, পড়ে রইলেন ও ভাবে। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে বিষিয়ে উঠল ক্ষতস্থান। পচন ধরল ডান হাতে, সেখান থেকে বিষ ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে, রক্তে। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে মারা গেলেন তিনি। নীরবে।
দিনটা ছিল ১৩ অগস্ট, ১৮৬৫। তার শেষকৃত্যে উপস্থিত হলেন না একজন চিকিৎসকও। হাঙ্গেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটিতে এক কলমও লেখা হল না তাকে নিয়ে।
তা হলে কি হারিয়েই গেলেন তিনি? না। দেরিতে হলেও তার মূল্যায়ন হল লুই পাস্তুরের হাত ধরে। স্বীকৃতি পেল তার গবেষণা। জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ জীবাণু থেকে রোগ হতে পারে তা মেনে নিলেন তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল তার নাম। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট আজও তার স্বাক্ষর বহন করছে।
সোর্সঃ আনন্দবাজার ও পূর্ব পশ্চিম