বর্তমান যুগে আমাদের সকলেরই একটি সাধারণ সমস্যা রাতে ঘুম না হওয়া এবং মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকা। আপনি নিজেও যদি মাঝরাতের পর না ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যাবে হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে, কেউ হয়তো নেশা করছে বা খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা বারবার মনে করে উদাস হচ্ছে। এরপর দেখা যাবে আপনি এক বোতল জুস অনায়াসে শেষ করে ফেলেছেন বা কিছুক্ষণ পর পরই ক্ষুধা লাগছে কিংবা আপনার মধ্যে খুব অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু কেনো? রাতে আমাদের এই আচরণ-এর পরিবর্তন বা হঠাৎ আসা এসব ডিপ্রেশন-এর সাথে Circadian Cycle (ঘুম এবং জাগরণের চক্র যা প্রতি ২৪ ঘন্টা পরপর পুনরাবৃত্তি ঘটে) এর গভীর সম্পর্ক আছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
সম্প্রতি Network Psychology এর Journal Frontiers পত্রিকায় বিস্তারিত প্রকাশিত এক গবেষণা-পত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, মানুষ যখন Biological Circadian night অর্থাৎ মাঝরাতের পরেও সজাগ থাকে তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের Neuropsychological পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের জন্য মানুষ দিনের বেলায় স্বাভাবিকভাবে বাইরের পরিবেশের সাথে যেভাবে যোগাযোগ করে থাকে মাঝরাতের পরে সেই যোগাযোগের ধরনে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও মস্তিষ্কের কিছু কার্যাবলি যেমন আবেগ নিয়ন্ত্রণ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, চিন্তা করার দক্ষতায় পরিবর্তন দেখা যায়।
এ ধরনের পরিবর্তনের কারণে মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে এবং বিভিন্ন বিপদজনক আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়। সাধারনত এমন সময়ে মানুষ আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যেমন বাস্তবতাকে ভুলে থাকার জন্য বিভিন্ন অপদ্রব্যের মাধ্যমে নেশায় জড়ানো, জুয়া খেলা বা এমন কিছু কাজ বাস্তবিক অর্থে ক্ষতিকর। কারণ এ সময় মানুষ তার সঠিক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলে।
মাঝরাতে আমরা যেসকল খাবার নির্বাচন করে থাকি, তাও প্রায় সময় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে থাকে। এসময় আমাদের দেহে যতটুকু ক্যালরি প্রয়োজন হয় আমরা তার চেয়েও বেশি ক্যালরি গ্রহণ করে থাকি।
রাতের সময়ই বেশিরভাগ মানুষ বিপদজনক কাজে জড়িয়ে থাকেন। Upenn’s Perelman School of Medicine এর Psychology এর সহকারী অধ্যক্ষ এবং ‘Mind After Midnight‘ প্রকল্পের সহকারী লেখক, PhD. Michael L.Perlis, এর মতে, যেসব লোক মাঝরাতের পরেও সজাগ থাকে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং আত্মহত্যার সময়টাও বেশিরভাগই হয়ে থাকে মাঝরাতে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, খারাপ কাজ কিংবা এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণগুলো রাতেই কেন বেশি ঘটে থাকে?
খুব সাধারণ একটি উত্তর হচ্ছে রাতের আধারে একজন মানুষের যেকোন অপরাধ করার জন্য উপযুক্ত সময় বলে মনে হয়। তবে এর এক জৈবিক ভিত্তিও রয়েছে। Klerman এর ব্যাখা অনুযায়ী নিউরনের কার্যকলাপের উপর Circadian Cycle এর প্রভাব প্রতি ২৪ ঘন্টা অন্তর অন্তর পরিবর্তিত হয়, Circadian Cycle এর এই প্রভাব দিনের আলোতে একভাবে এবং রাতে অন্যভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। এই পরিবর্তন আমদের মস্তিষ্কেও এক ধরনের পরিবর্তন আনে যার ফলে আমরা বাইরের পরিবেশের সাড়ায় দিনে এবং রাতে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকি।
এছাড়াও স্বাভাবিকভাবেই রাতে আমদের শরীর অধিক পরিমাণে ডোপামিন নিঃসৃত করে, যা আমাদের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়াতে উদ্ধুদ্ধ করে তোলে। আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশ চিন্তাভাবনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে এবং খারাপ আবেগকে সরিয়ে নির্দিষ্ট কোন কাজে মনোযোগ দিতে সহায়তা করে, তাও মাঝরাতের পর প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, ফলে ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে সহজেই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরে। এছাড়াও এই রাতে জেগে থাকা অনেক সময় রুমিনেশন-Rumination এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে ব্যক্তি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েই দিন রাত চিন্তা করতে বা কথা বলতে থাকে, যা পরবর্তীতে এংজাইটি ডিজঅর্ডার বা ডিপ্রেশনে রূপান্তরিত হতে পারে।
Klerman এই প্রকল্পের ভিত্তিতে গবেষকদের নতুনভাবে গবেষণার জন্য আহবান জানান, কীভাবে Circadian clock মানুষের আচার আচরণ, সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াকরণ এবং কাজকর্মকে প্রভাবিত করে। এই গবেষণাটি মানুষকে মাঝরাতের পরের সময়টাতেও কীভাবে নিজেকে সামলানো যায় তা জানতে সাহায্য করবে।
এই গবেষণাটি যেসব কর্মীদের রাতে কাজ করতে হয় যেমনঃ পাইলট, পুলিশ অফিসার, মিলিটারি কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মীর মতো লোকদের জন্য বিরাট প্রভাব রাখবে। এর মাধ্যমে গবেষকরা নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে পারেন যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অপদ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, আত্মহত্যা, অনিদ্রা ও এর সাথে সম্পর্কিত রাতে জেঁকে বসা ডিপ্রেশন এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক আচরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
দিদারুল ইসলাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক