রক্তদান নিঃসন্দেহে একটি মহৎ কাজ। একটি জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকে সহায়তা করার একটি নিরাপদ, দ্রুত এবং সহজ উপায় হচ্ছে রক্তদান। আমাদের মধ্যে অনেকেরই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রক্তদান করতে পারি না। কিন্তু কেন?? -কারণগুলো আলোচনা করছি।
রক্তদানের মানদণ্ড
- সাধারণ রক্তদানের মানদণ্ড অনুসারে রক্তদাতাদের অবশ্যইঃ
- কমপক্ষে ১৬ বছর বয়সের হতে হবে।
- কমপক্ষে ১১০ পাউন্ড/ ৪৯.৮৯৫কেজি (প্রায় ৫০কেজি) ওজন হতে হবে।
- সর্দি বা ফ্লু জাতীয় হালকা অসুস্থতাও নেই।
- আনমেডিকেটেড ডায়াবেটিস, রক্তাল্পতা বা উচ্চ রক্তচাপ নেই।
কাদের রক্তদান করা উচিৎ নয়?
রক্ত দিতে সক্ষম না এমন লোকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তঃ
- যারা চিকিৎসকের পরামর্শকৃত নয় এমন কোন ওষুধ, স্টেরয়েড বা অন্যান্য পদার্থ গ্রহণের জন্য সুই ব্যবহার করেছেন।
- যারা অর্থ বা মাদকের জন্য যৌন সম্পর্কে জড়িত।
- এইচআইভি (HIV) বা Creutzfeldt-Jakob disease (CJD) এমন রোগের পরীক্ষায় পজিটিভ যারা।
- যেসব পুরুষ গত ৩ মাসের মধ্যে অন্য পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্কে ছিল।
অনুদানের ধরনের ভিত্তিতে কিছু মানদণ্ডঃ
স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীরা ট্রান্সফিউশনে চারটি পৃথক রক্ত উপাদান ব্যবহার করেন: Whole Blood,পাওয়ার রেড, প্লেটলেট এবং এবি এলিট প্লাজমা। রক্তদানের মানদণ্ড এসবের উপর নির্ভর করে কিছুটা পৃথক হয়।উপাদানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
- Whole Blood
Whole blood এ লাল এবং সাদা রক্তকণিকা, প্লেটলেট এবং প্লাজমা থাকে। রক্তের ব্যাংকগুলি whole blood এর বিভিন্ন উপাদানগুলিকে আলাদা করে কারণ বেশিরভাগ লোকের রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজনে সব উপাদানের প্রয়োজন হয় না।
Whole blood দানের জন্য অবশ্যইঃ
- কমপক্ষে ১৬ বছর বয়সের হতে হবে।
- কোন রকম অসুস্থতা থাকা যাবে না।
- কমপক্ষে ১১০ পাউন্ড/৪৯.৮৯৫কেজি(প্রায় ৫০কেজি) ওজন হতে হবে।
আপনি প্রতি ৫৬ দিন (৮ সপ্তাহ) পর পর Whole Blood দান করতে পারেন। এই বিরতিতে শরীর বের হয়ে যাওয়া রক্ত পুনরায় পূরণ করে।
- পাওয়ায় রেড (Power red)
মানুষ অ্যাফেরেসিস (Apheresis)এর মাধ্যমে Power red দান করতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটি Whole blood থেকে প্রয়োজনীয় উপাদানটি নিয়ে,অপ্রয়োজনীয় রক্ত দাতার শরীরে ফিরিয়ে দেয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ্ ব্লাড ব্যাংক ডাবল রেড সেল অ্যাফেরেসিস (Double Red Cell Apheresis-DRCA) নামক একটি প্রক্রিয়া আছে। DRCA ব্লাড ব্যাংক কর্মীদের একবারেই দুই ইউনিট (দুইবার অনুদানের সমতুল্য) Power red গ্রহণের অনুমতি দেয়।
Power red দানের জন্য অবশ্যইঃ
- কোন রকম অসুস্থতা থাকা যাবে না।
- পুরুষ হলে কমপক্ষে ১৭ বছর বয়সী হতে হবে, সর্বনিম্ন ৫ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে এবং কমপক্ষে ১৩০ পাউন্ড/৫৮.৯৬৭ কেজি(প্রায় ৫৯কেজি) ওজনের হতে হবে।
- মহিলা হলে ১৯ বছর বয়সী হতে হবে, সর্বনিম্ন ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা এবং কমপক্ষে ১৫০ পাউন্ড/৬৮.০৩৯ কেজি ওজনের হতে হবে।
আপনি প্রতি ১১২ দিন পর পর Power red দান করতে পারেন। তবে বছরে তিনবারের বেশি দান করতে পারবেন না।
- প্লেটলেট (Platelets)
প্লেটলেটগুলি whole blood এর কোষ যা রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। দেহ অস্থি মজ্জার মধ্যে প্লেটলেট উৎপন্ন করে এবং তা প্লীহায় জমা রাখে।
যখন কোন ব্যক্তি আহত হয়, প্লেটলেটগুলি আঘাতের জায়গায় প্রতিরক্ষামূলক বাধা তৈরি করে যেন রক্তপাত না হয়। প্লেটলেট দাতাদের অ্যাফেরেসিস (Apheresis) এর মধ্য দিয়ে যেতে হয় Whole blood থেকে প্লেটলেটগুলি আলাদা করার জন্য।
প্লেটলেট দানের জন্য অবশ্যইঃ
- কোন রকম অসুস্থতা থাকা যাবে না।
- ১৭ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী হতে হবে।
- কমপক্ষে ১১০ পাউন্ড/৪৯.৮৯৫কেজি(প্রায় ৫০কেজি) ওজন হতে হবে।
আপনি প্রতি ৭ দিন পর পর প্লেটলেট দান করতে পারেন। তবে বছরে ২৪ বারের বেশি অনুদান করতে পারেন না।
এবি এলিট প্লাজমা (AB elite plasma)
প্লাজমা Whole Blood এর বর্ণহীন হলুদ তরল। এটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে এবং রক্ত জমাট বাঁধাতে সাহায্য করে। এবি প্লাজমা সর্বজনীন দাতা প্লাজমা কারণ এটি সব ধরনের রক্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্লাজমা দাতাদের অ্যাফেরেসিস (Apheresis)এর মধ্য দিয়ে যেতে হয় Whole Blood থেকে প্লাজমা বের করার জন্য।
এবি এলিট প্লাজমা অনুদানের জন্য অবশ্যই:
- রক্তের গ্রুপ AB হতে হবে।
- কোন রকম অসুস্থতা থাকা যাবে না।
- কমপক্ষে ১৭ বছর বয়সী হতে হবে।
- কমপক্ষে ১১০ পাউন্ড/৪৯.৮৯৫কেজি(প্রায় ৫০কেজি) ওজন হতে হবে।
আপনি প্রতি ২৮ দিন পরপর এবি এলিট প্লাজমা দান করতে পারেন। তবে বছরে ১৩ বারের বেশি দান করতে পারবেন না।
রক্তদাতার উপর ভিত্তি করে রক্তদানের কিছু মানদণ্ডঃ
ওষুধ গ্রহণ:
সাধারণত, ওষুধ রক্তদানে কোন সমস্যা করে না। তবে অনেক সময় কিছু ওষুধ গ্রহণের কারণেই রক্তদান করা সম্ভব হয় না, এতে কিছু শর্ত থাকে, শর্তগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে রক্তদানে কোন সমস্যা হয় না।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ, হারবাল এবং ভিটামিন পরিপূরকগুলি গ্রহণ করা যায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের শেষ ডোজ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে রক্ত দানের জন্য। বিভিন্ন ওষুধের জন্য অপেক্ষা করার সময়কাল সম্পর্কে বর্ণনা করছি।
- হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ওষুধ, যেমনঃ ক্লোপিডোগ্রেল (Plavix) এবং টিক্লোপিডিন (Ticlid), ইত্যাদি
সময়কালঃ Whole blood দানের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই, তবে অ্যাফেরেসিস দ্বারা প্লেটলেটগুলি দান করার জন্য শেষ ডোজের পর ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
-
অ্যাসপিরিন
সময়কালঃ Whole blood দানের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই, তবে অ্যাফেরেসিস দ্বারা প্লেটলেটগুলি দান করার জন্য শেষ ডোজের পর ২ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
- প্রেসক্রিপশন ব্লাড টিনারস (prescription blood thinners) যেমন: fondaparinux (Arixtra)
সময়কালঃ শেষ ডোজের পর ২ দিন অপেক্ষা করতে হবে এবং ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে রক্তদান করতে হবে।
- ব্রণের ওষুধ, যেমনঃ আইসোট্রেটিনিন (Accutane and Amnesteem)
সময়কালঃ শেষ ডোজ এর পর এক মাস অপেক্ষা করতে হবে রক্তদানের জন্য।
- থ্যালিডোমাইড যেমনঃ থ্যালোমিড (Thalomid)
সময়কালঃ শেষ ডোজের পর ১মাস অপেক্ষা করতে হবে রক্তদানের জন্য।
- মাইকোফেনোলেট মফিটিল (mycophenolate mofetil)যেমনঃ সেলসেপ(Cellcept)
সময়কালঃ শেষ ডোজের পর ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
- বর্ধিত প্রস্টেটের জন্য ওষুধ যেমন dutasteride,অ্যাভোডার্ট (Avodart)
সময়কালঃশেষ ডোজের পর ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
- টেরিফ্লুনোমাইড (
teriflunomide)
সময়কালঃ শেষ ডোজের পর ২ বছর।
- বাতের ওষুধ যেমনঃ লেফ্লুনোমাইড (leflunomide) এবং ভিসমোডেগিব (vismodegib)
সময়কালঃশেষ ডোজের পর ২ বছর।
- অ্যাসিট্রেটিন (acitretin)
সময়কালঃ শেষ ডোজের পর ৩বছর অপেক্ষা করতে হবে।
কিছু মেডিকেল শর্তঃ
- অ্যালার্জি এবং শুকনো কাশি
এসবে আক্রান্ত ব্যাক্তি রক্তদান করতে পারে,যদি জ্বর না থাকে এবং ব্যক্তি তাদের মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে পারে।
হাঁপানি থাকলেও রক্তদান করতে পারবে যদি শ্বাস নিতে অসুবিধা না হয়।
- রক্তক্ষরণ অবস্থা
এ অবস্থায় রক্তদান না করাই ভালো, খুব জরুরী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ক্যান্সার যদি লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা ধরনের হয় এবং এ ধরনের ক্যান্সার থেকে ভালো হওয়ার পরও রক্তদান করা যাবে না। অন্যান্য ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসায় ভালো হওয়ার ১২ মাসের পর রক্তদানে কোন সমস্যা নেই।
সিজেডি আক্রান্ত হলে রক্তদান করা যাবে না।
রক্তদান করা যাবে,যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- ইবোলা (Ebola)
ইবোলায় আক্রান্ত হলে রক্তদান করা যাবে না।
রক্তদান করা যাবে যদি শেষ লক্ষণ দেখা যাওয়ার কমপক্ষে ৬মাস পরে।
রক্তদান করা যাবে তবে সম্ভাব্য হেপাটাইটিস এক্সপোজারের ১২ মাস পরে।
-
এইচআইভি বা এইডস
না,রক্তদান করা যাবে না এমন রোগে আক্রান্ত হলে।
সিফিলিস এবং গনোরিয়ার সফল চিকিৎসার ১২মাস পরে রক্তদান করা যাবে।
- সিকল সেল (sickle cell)
রক্তদান করা যাবে যদি কেবল সিকল সেলের বৈশিষ্ট্য থাকে, যদি কোন ব্যক্তির সিকল সেল থাকে তবে তারা দান করতে পারবে না।
যক্ষ্মা সক্রিয় থাকলে রক্তদান করা যাবে না।
- জিকা ভাইরাস
সংক্রমণ মুক্ত হওয়ার ১২০দিন পর রক্তদান করা যাবে।
- উল্কি (Tattoos)
অনেকেই মনে করে ট্যাটু থাকলে রক্তদান করা যাবে না, এটা ভুল ধারণা। ট্যাটু আছে এমন বেশিরভাগ লোক রক্ত দান করতে পারেন, যদি তাদের ঝুঁকির কোন কারণ দেখা না দেয়।
যদি ট্যাটু শিল্পী প্রতিটি ট্যাটুর জন্য জীবাণুমুক্ত সূঁচ এবং নতুন কালি ব্যবহার করে এবং তা রাষ্ট্র-লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হয় তবে রক্তদান করতে পারবে, এতে অপেক্ষা করতে হবে না। অন্যথায়, ১২মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে, ট্যাটুর জন্য কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
- দেশের বাইরে থেকে এসে রক্তদান
যদি কোন ব্যক্তি দেশের বাইরে থেকে আসে এবং কিছু নির্দিষ্ট রোগের ঝুঁকিতে থাকে তবে রক্ত দেওয়ার আগে তাদের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গর্ভাবস্থা এবং বুকের দুধ খাওয়াতে হয়- এমন অবস্থায় কী রক্তদান করা যাবে?
গর্ভবতী মহিলারা রক্তদান করতে পারবে না। যে সমস্ত মহিলারা বুকের দুধ খাওয়ান তারা রক্তদান করতে পারেন, তবে সন্তান জন্ম দেওয়ার ৬ সপ্তাহের পর।
Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এর মতে,
- অনেকে দেশে আসার ১ বছর পর্যন্ত রক্ত দিতে পারেন না, জরুরী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা ৩ বছরের জন্য রক্তদান করতে পারবে না।
- যাদের ম্যালেরিয়া আছে তারা চিকিৎসায় ভালো হওয়ার আরও ৩ বছর পর রক্তদান করতে পারবে।
আমেরিকান রেড ক্রসের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ২ সেকেন্ডে কারও না কারও রক্তের প্রয়োজন হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬.৮ মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছর রক্ত দান করে, তবে সংখ্যাটা হ্রাস পাচ্ছে।
রক্তদানে ঝুঁকির সম্ভবনা অনেক কম বরং আপনার শরীরের জন্য অনেক উপকারী। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, রক্ত দিন এবং একটি জীবন বাঁচান। এর চেয়ে মহৎ কাজ আর কি হতে পারে!
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: মেডিক্যাল নিউজ টুডে