এটি এমনই এক বিস্ময়কর মুহূর্ত যা সব দর্শককে অবাক করে দেয়। পরিকল্পিত ভাবে নির্মিত শহরের রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে সূর্য এক ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত তৈরি করে এবং অসাধারণ আলোর খেলা দেখায়।
না, আমরা ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ স্টোনহেঞ্জের অদ্ভুত সৌর ঘটনার কথা বলছি না। আমরা আধুনিক শহর নিউইয়র্কের ম্যানহাটন স্ট্রিটের অবাক করা সৌর ঘটনা ম্যানহাটনহেঞ্জ এর কথা বলছি, যা ম্যানহাটন সল্টিস নামেও পরিচিত।
আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির জ্যোতির্বিজ্ঞানি নীল ডিগ্রাস টাইসন ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারের বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিসৌধ স্টোনহেঞ্জের অদ্ভুত সৌর ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সর্বপ্রথম ১৯৯৭ সালে ম্যানহাটন স্ট্রিটের সৌরঘটনাকে ম্যানহাটনহেঞ্জ নামে নামকরণ করেন। এই ঐতিহাসিক নামকরণ সম্পর্কে টাইসন বলেন,
“আমার বয়স যখন ১৫ বছর ছিল তখন আমি জ্যোতির্বিদ জেরাল্ড হকিন্সের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অভিযানে প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিসৌধ স্টোনহেঞ্জের সৌর ঘটনা দেখতে যাই। যেখানে উদীয়মান সূর্য স্টোনহেঞ্জের বাইরের হিল স্টোনের চূড়ায় এসে মিলিত হয় যা স্টোনহেঞ্জের কেন্দ্র থেকে দেখা যায়। আর ম্যানহাটনের ঘটনায় সূর্য রাস্তার গ্রীডের সাথে মিলিত হয়ে ধীরেধীরে অস্ত যায়। উভয় ঘটনার মধ্যেই আমি মিল খুঁজে পাই তাই আমি এর নামকরণ করি “ম্যানহাটনহেঞ্জ”।”
কীভাবে ম্যানহাটনহেঞ্জ ঘটে ?
প্রায় ২০০ বছর আগে আধুনিক ম্যানহাটনের যে গ্রীড পরিকল্পনা করা হয় যেখানে ম্যানহাটন স্ট্রিটের রাস্তাগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়ে “X” আকারে মিলিত হবে। এই পরিকল্পনার ফলে ম্যানহাটন স্ট্রিটে সূর্যের আলোর খেলা দেখানোর জন্য নিখুঁত জায়গার সৃষ্টি হয়। সূর্যাস্তের সময় নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনের মূল স্ট্রিট গ্রিডের রাস্তাগুলোর সাথে সূর্য মিলিত হয়ে দিগন্তের নীচে ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়ার আগে উঁচু ভবনগুলোর মাঝে বিপরীত দিক হতে এসে “X” আকারে মিলিত হওয়া রাস্তাগুলোকে পুরোপুরি আলোকিত করে। আর সূর্যের এই আলোর খেলাই বর্তমানে ম্যানহাটনহেঞ্জ নামে পরিচিত।
কখন এই বিরল ঘটনার দেখা মিলে ?
গ্রীষ্মকাল এবং শীতকালের কাছাকাছি সময়ে প্রতিবছর দু’বার করে সূর্যাস্তের সময় মোট চারবার ম্যানহাটনহেঞ্জ এর দেখা মিলে। প্রথমে সূর্যের অর্ধেক অংশ রাস্তার গ্রীডের সাথে মিলিত হয় এবং পরে সম্পূর্ণ সূর্যই রাস্তার গ্রীডের সাথে মিলিত হয়। ম্যানহাটনের ১৪, ২৩, ৩৪, ৪২ এবং ৫৭ নাম্বার রাস্তা থেকে ম্যানহাটনহেঞ্জ সবচেয়ে ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। এছাড়া নিউ জার্সি থেকেও ম্যানহাটনহেঞ্জ পরিস্কার ভাবে দেখা যায়। ম্যানহাটনহেঞ্জ অনেকটাই আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল আকাশ যতো পরিস্কার থাকে ম্যানহাটনহেঞ্জ ততো ভালোভাবে দেখা যায়।
উল্লেখ্য ২০২০ সালে মে মাসের ২৯ তারিখ ও জুলাই মাসের ১২ তারিখে ম্যানহাটনহেঞ্জ ঘটবে।
বিপরীত ম্যানহাটনহেঞ্জ
আপনার যদি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস থাকে তাহলে আপনার বিপরীত ম্যানহাটনহেঞ্জ দেখার সুযোগ রয়েছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে ভোরবেলা উদীয়মান সূর্য ম্যানহাটনের রাস্তার সাথে মিশে গিয়ে বিপরীত ম্যানহাটনহেঞ্জের সৃষ্টি করে। শীতের পরিষ্কার সকালে বিপরীত ম্যানহাটনহেঞ্জ সাধারণ ম্যানহাটনহেঞ্জের মতোই আলোর খেলা দেখায়।
ম্যানহাটন ছাড়াও শিকাগো, মন্ট্রিয়াল, টরেন্টো, বোস্টন সহ পৃথিবীর অনেক শহরের রাস্তায় এরকম সূর্যের আলোর খেলা দেখা যায়। জ্যোতির্বিদ শেন লারসনের মতে আপনার আশেপাশে কোন রাস্তা যদি পূর্ব-পশ্চিম দিক হতে আসে তাহলে সেই রাস্তায়ও এরূপ আলোর খেলা দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই আলোর খেলা দেখার জন্য আপনার সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত থাকা প্রয়োজন।
১৮০০ সালে করা ম্যানহাটন স্ট্রিটের গ্রীড পরিকল্পনা এবং ভৌগলিক অবস্থানের ফলে প্রায় ২০০ বছর ধরে নিউইয়র্কের বাসিন্দারা ম্যানহাটনহেঞ্জ উপভোগ করে আসছিল। কিন্তু ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তারে বিগত দুই দশক হতে ম্যানহাটনহেঞ্জ একটি বৈশ্বিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাজার হাজার মানুষ ম্যানহাটনহেঞ্জ দেখতে জড় হয়। সময়ের সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
তাহমিদ শিহাব / নিজস্ব প্রতিবেদক