কখনও ভেবেছেন কি এমন যদি হতো আপনার হাতের মোবাইলফোনটি একটি উদ্ভিদ বা বিশেষ কোনো মাশরুম দ্বারা চার্জ হচ্ছে? জ্বি হ্যাঁ, বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে ভবিষ্যতে আমরা মাশরুম এর সাহায্যেই শক্তি সঞ্চয়, বিনিময় করতে পারবো!
বর্তমান সময়ে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হলো শক্তি সঞ্চয় এবং পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো। বিজ্ঞানীরা এর সমাধান হিসেবে মাশরুম কে বেছে নিয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা শক্তি সঞ্চয়, পরিস্রাবণ এবং পরিবেশবান্ধব কার্বন-ভিত্তিক উপকরণ তৈরি করার জন্য ছত্রাক বা মাশরুম ব্যবহার করছেন। বর্তমানে, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, তাদের রিচার্জেবল প্রকৃতি (শক্তি শেষ হয়ে গেলে তা আবার পুনরায় উৎপাদন করার ক্ষমতা) এবং শক্তি সঞ্চয়ের ক্ষমতার জন্য প্রচুর ব্যবহৃত হয় ৷ এটি আধুনিক জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এমনকি আপনারা এখন সংবাদটি পড়ার জন্য যেই ডিভাইসটি ব্যবহার করছেন সেটিকেও এই ব্যাটারি শক্তি সরবরাহ করছে!
তবে এই ব্যাটারির মূল উপাদান হলো গ্রাফাইট। গ্রাফাইট কার্বন এর সবচেয়ে স্থিতিশীল রূপ। গ্রাফাইট হলো কার্বনের একটি অ্যালোট্রপ, এমন কিছু মৌল যাদের বিভিন্ন পারমাণবিক আকার থাকতে পারে। উচ্চমানের গ্রাফাইট ব্যাটারিতে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত কিন্তু পরিবেশে এর পরিমাণ সীমিত।
স্কুল অফ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং স্কুল অফ ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন সহযোগী অধ্যাপক ভিলাস পোল বলেন,
“ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক যানবাহন এর চাহিদা আরও বাড়বে, তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বর্তমান লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিগুলিকে শক্তির পরিমাণ এবং পাওয়ার আউটপুট উভয় ক্ষেত্রেই উন্নত করতে হবে।“
তাই বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই গ্রাফাইট এর বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং বিষদ গবেষণার পর তারা মাশরুম বা ছত্রাক ব্যবহার করে শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছে। এ গবেষণার অন্যতম লেখক মিচেল জোন্স বলেন,
“আমরা কার্বনে রূপান্তরিত ছত্রাকের ফিলামেন্টগুলো ব্যবহার করে জীবাশ্ম সম্পদের উপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে পারি।”
যদি একটি পোর্টোবেলো মাশরুমকে একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে জুম করে দেখা হয়, তাহলে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত কার্বন ন্যানোরিবন দেখতে পাবো যা গ্রাফাইটের চেয়ে শক্তি সঞ্চয় এবং স্থানান্তর করার ১.৫ গুণ বেশি কার্যকরী হতে পারে।
গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায়, একদল গবেষক সুপার ক্যাপাসিটর নামক শক্তি সঞ্চয়কারী যন্ত্রে কার্বন ফিলামেন্ট ব্যবহার করেছে যা ব্যাটারির মতো ইলেক্ট্রোডের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পৃথক করে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করতে পারে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদ-ভিত্তিক কার্বন ফাইবার খুঁজে বের করেছে। তবে জোন্স বলছেন,
“যেহেতু এই ফিলামেন্টগুলো (মাশরুম) সুন্দর ও ছোট, সেহেতু তারা সাধারণত সাধারণ উদ্ভিদ থেকে কম শক্তি ক্ষয় করবে।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন,
“কার্বনে রূপান্তর করার আগে আমাদের প্রথমে উদ্ভিদের তন্তু বা ফিলামেন্টগুলোকে সঠিক আকারে নেয়ার জন্য একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যার জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন। কিন্তু ফাঙ্গাস বা মাশরুম এর বেলায় আমাদের তা করতে হবে না কারণ এরা (মাশরুম) কম শক্তি ক্ষয় করে এবং প্রাকৃতিক ভাবেই তাদের খুব ক্ষুদ্র তন্তুময় গঠন রয়েছে যা সুপার ক্যাপাসিটর তৈরির জন্য উপযুক্ত।”
Power EEtimes এর মতে, মাশরুমের মতো ছত্রাকের মধ্যে যে তন্তুগুলোর গঠন বিদ্যমান তা দ্রুত ইলেকট্রন পরিবহণ করতে পারবে, ফলে এটিকে কোনো ব্যাটারির সাথে যুক্ত করলে তা খুব দ্রুত রি-চার্জ করতে পারবে, অনেকটা ফাস্ট চার্জিং এর মতো।
গবেষকরা তাদের কাজের জন্য সাধারণ White Button এবং King Oyster মাশরুম ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন মাশরুমের বিভিন্ন ফাইবার গঠন রয়েছে, যা প্রজাতি এবং পরিবেশগত অবস্থার উপর নির্ভর করে যেখানে তারা জন্মায়, যেমন আপেক্ষিক তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা।
জোন্স আরও বলে,
“যখন ছত্রাক এমন পরিবেশে বৃদ্ধি হয় যেখানে ধাতু, অজৈব লবণ এবং এই জাতীয় বস্তুর ঘনত্ব বেশি থাকে, তখন মাশরুম এগুলো শোষণ করে, ফলে এসব বস্তু তাদের ফাইবার কাঠামোর সাথে মিশে যায়। এর অর্থ হলো যে আমরা মাশরুম নির্বাচনে সাবধান থাকি এবং এটিকে এমন একটি পরিবেশে বড় করি যেখানে আমরা ধাতু এবং লবণ যুক্ত করেছি, ফলে এর মধ্যে ঐসব ধাতুর ঘনত্ব দেখা যায় এবং এটি অনেকটা পরিবাহীর মতো আচরণ করে।”
প্রাথমিক ল্যাব পরীক্ষায়, দুটি মাশরুম প্রজাতি থেকে প্রাপ্ত কার্বনের একটি নির্দিষ্ট ক্যাপাসিট্যান্স (বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয় করার জন্য একটি বস্তু বা যন্ত্রের ক্ষমতা) পাওয়া যায়, যা তার মধ্যে প্রতি ইউনিট বৈদ্যুতিক চার্জ সংরক্ষণ করার ক্ষমতাকে বোঝায়। এ মানটি YP-50F carbon নামক নারকেলের খোসা থেকে প্রাপ্ত একটি বাণিজ্যিক ক্যাপাসিটর থেকে কিছুটা কম।
এ পরীক্ষণে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও দলটি আশা করে যে মাশরুম-ভিত্তিক উপজাতের প্রাচুর্যের কারণে অগ্রগতি করা যেতে পারে।
তারা তাদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, “আমরা উদ্ভিদের সাহায্যে আরও সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সুপার ক্যাপাসিটর তৈরি করতে পারবো।”
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেকজান্ডার ব্যাখ্যা করেছেন,
“জৈবিক জীবের উপর কাজ করা কখনই সোজা নয়। আমাদের সর্বদা নমুনা থেকে নমুনা পরীক্ষণ করতে হয় এবং কখনও কখনও ফলাফলগুলোর পুনরাবৃত্তিও করার প্রয়োজন হতে পারে। এর কারণ প্রকৃতিতে অনেক সহজাত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“কিছু বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র বাদে সবক্ষেত্রেই একই পরীক্ষণ বারবার পুনরাবৃত্তি করতে হয়, প্রতিটি মাশরুম এবং এর উত্থিত উপাদানের নিজস্ব বিশেষত্ব রয়েছে। তাই বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক ফলাফল লাভের জন্য সবসময় অতিরিক্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”
এই গবেষণা যদি সফল হয় তাহলে ভবিষ্যতে শক্তির ঘাটতি অনেকাংশেই কমানো সম্ভব এবং শক্তি সংরক্ষণে ছত্রাক এর ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও অনেক কাজে দিবে। সেই দিন বেশী দূরে নয় যখন আমরা একটি মাশরুম বা ছত্রাকের মাধ্যমে আমাদের প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চার্জ করতে পারব।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ অ্যাডভান্সড সায়েন্স নিউজ