শারীরিক নির্যাতন আমাদের কাছে পরিচিত হলেও মানসিক নির্যাতন অতটা পরিচিত নয়। মানসিক নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছু ক্ষেত্রে তা শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও ভয়ংকর। মানসিক নির্যাতনের প্রভাব দীর্ঘ এবং স্বল্প মেয়াদী উভয়ই হতে পারে। প্রভাবগুলো দেখা যেতে পারে শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক (উদ্বেগ এবং অপরাধবোধ) বা উভয় ভাবেই। পরিবারের সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশী, রোমান্টিক অংশীদার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে নানাভাবে কোন ব্যক্তি মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে পারে।
সম্পর্কের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনঃ
রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সংবেদনশীল বা ইন্ট্রোভার্ট লোকেরা প্রথমে শারীরিক বা যৌনতার দিকে যেতে পারে না। সেক্ষেত্রে তার সঙ্গী যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে সম্পর্কটি অব্যাহত রাখে তবে মানসিক ও শারীরিক উভয়প্রকার নির্যাতনের দিকে ধাবিত করে।
চলুন মানসিক নির্যাতনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো জেনে নেওয়া যাক।
মানসিক নির্যাতনের স্বল্পমেয়াদী প্রভাবঃ
মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সকল ক্ষেত্রেই ব্যক্তির মাঝে বিভ্রান্তি, ভয়, হতাশা, লজ্জা কাজ করে। এই মানসিক বিষয়গুলো ছাড়াও আচরণগত এবং শারীরিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আপনার বেশ কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হতে পারে। যেমনঃ
– মনোসংযোগে অসুবিধা,
– মেজাজ খিটখিটে হওয়া,
– পেশীতে টান,
– দুঃস্বপ্ন দেখা,
– বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা এবং যন্ত্রণা।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবঃ
গুরুতর মানসিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতনের মতোই শক্তিশালী হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে অনেকটা বিষণ্ণতার সৃষ্টি করতে পারে। আরও নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন-
– উদ্বেগ,
– দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা,
– অপরাধবোধ,
– অনিদ্রা,
– একাকীত্ব।
কিছু গবেষক স্বীকার করেন যে, মানসিক নির্যাতন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির কারণও হয়।
শিশুদের মানসিক নির্যাতনঃ
শিশু সহ সকল বয়সের লোকেরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে। কোনও আত্মীয়, পারিবারিক বন্ধু বা অপরিচিত কারোর থেকে শিশুরা মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
শিশুদের প্রতি মানসিক নির্যাতনের কয়েকটি লক্ষণের মধ্যে রয়েছে:
– শিশুকে বধ করা, ধর্ষণ করা বা হুমকি দেওয়া,
– কোনও শিশুকে লজ্জা দেওয়া, বদনাম করা বা লাঞ্ছিত করা,
– নেতিবাচকভাবে অন্য শিশুদের সাথে একটি শিশুর তুলনা।
এটি শিশুদের আলাদাভাবে প্রভাবিত করে। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো, শিশুদের মানসিক নির্যাতন অচেনা-ই থেকে যেতে পারে। যদি কোনও শিশু মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় তবে তার মাঝে সামাজিক প্রত্যাহার, রিগ্রেশন, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
যদি শিশুকালেই এর সমাধান না করা হয় তবে বড় হওয়ার পরেও এই সমস্যাগুলো থেকে যেতে পারে। শৈশবে যারা অবহেলিত ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিল, প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তাদের দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা বিকাশের সম্ভাবনাও বেশি হতে পারে।
মানসিক নির্যাতন এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD):
পিটিএসডি (PTSD) হলো একটি মানসিক ব্যাধি যা এমন লোকদের মধ্যে ঘটতে পারে যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মারাত্মক দুর্ঘটনা, সন্ত্রাসবাদী ঘটনা, ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতা হওয়ার হুমকির মতো ট্রমাজনিত ঘটনার প্রত্যক্ষ বা সাক্ষী হয়ে থাকে। মানসিক নির্যাতন সর্বদা পিটিএসডি-র দিকে যায়না, তবে তা একটা সময় এই মানসিক ব্যাধির দিকে মোড় ঘুরতে পারে।
পিটিএসডি কখনো ভয়ঙ্কর বা মর্মস্পর্শী ঘটনার পরে দেখা দিতে পারে। এই অনুভূতিগুলি সাধারণত এত মারাত্মক হয় যে এগুলি আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা দেয়।
পিটিএসডি এর অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
– ক্রুদ্ধ আক্রমন
– সহজেই চমকে উঠা
– নেতিবাচক চিন্তা
– অনিদ্রা
– দুঃস্বপ্ন দেখা ইত্যাদি।
পিটিএসডি এর চিকিৎসা প্রায়শই থেরাপি এবং এন্টিডিপ্রেসেন্টস দিয়ে করা হয়।
মানসিকভাবে নির্যাতিত ব্যক্তি কখন রিকভারি শুরু করতে প্রস্তুত হবেনঃ
মানসিক নির্যাতন থেকে বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে যা মোটেও উপেক্ষা করা উচিত নয়। প্রত্যেকে একই সময়ে রিকভারি শুরু করতে প্রস্তুত থাকে না বা প্রত্যেকের ঘুরে দাঁড়ানোর উপায়ও একই নয়।
কীভাবে আপনি রিকভার করার প্রস্তুতি নিবেন তার কিছু টিপস উপস্থাপন করা হলোঃ
নিজের সমর্থন খুঁজুন-
আপনাকে একা এই পথে যেতে হবে না। কোনো বিশ্বস্ত বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলুন যারা কোনো ভণিতা ছাড়াই আপনার কথা শুনবেন। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো শেয়ার করুন। নিজের পক্ষে সমর্থন সৃষ্টি করুন।
শারীরিকভাবে সক্রিয় হোন-
শারীরিকভাবে আপনাকে আরও ফিট রাখার জন্যে অনুশীলন/ব্যায়াম অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, সপ্তাহে কমপক্ষে ৯০ মিনিটের জন্য পরিমিত এরোবিক্স ক্রিয়াকলাপ গুলো করতে পারেন। যা আপনাকে আরও ভালো ঘুমাতে সহায়তা করে। এতে হতাশা এবং উদ্বিগ্নতার ঝুঁকি হ্রাস হবে। এমনকি দৈনিক হাঁটার মতো সহজ শারীরিক কার্যকলাপও অনেক উপকারী হতে পারে।
আপনি যদি বাড়ির ওয়ার্কআউটগুলিতে আগ্রহী না হন তবে নির্দিষ্ট কিছু এক্সারসাইজে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করুন। সেটি সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, মার্শাল আর্ট বা নাচও হতে পারে-যা কিছু আপনার ভালো লাগে।
সামাজিক হোন-
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এত ধীরে ধীরে ঘটে যে, কেউ খেয়ালও করে না। এটি কোন ভালো দিক নয়।
বন্ধুরাই আপনাকে এটি নিরাময় করতে সহায়তা করতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে আপনার সমস্যার বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলতে হবে (আপনি না চাইলে)। কেবল অন্যের সঙ্গ উপভোগ করা এবং স্বীকৃত বোধ করা আপনার মানসিক শান্তি বাড়িয়ে তুলতে যথেষ্ট। পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠান, বন্ধুদের গেট টুগেদার এসব ইভেন্টে যোগ দেন। এতে আপনি আপনার বিষণ্ণতা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হতে পারেন।
ডায়েটে মন দিন-
মানসিক অবসন্নতা আপনার ডায়েটের সর্বনাশ করে দিতে পারে। এটি আপনার ওপর খুব সামান্য বা খুব বেশি পরিমাণে প্রভাব ফেলতে পারে।
এখানে কিছু টিপস রয়েছে যা আপনার শক্তির স্তর উপরে রাখতে এবং মেজাজের পরিবর্তনগুলি কমাতে সহায়তা করতে পারেঃ
> বিভিন্ন ফলমূল, শাকসবজি খান,
> সারাদিনে বেশ কয়েকবারে ভাগ করে সুষম খাবার খান,
> অ্যালকোহল এবং ড্রাগ এড়িয়ে চলুন,
> চিনিযুক্ত, ভাজা এবং অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলু্ন,
> পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
আপনি কিছু কৌশল অনুশীলন করে স্ট্রেসকে সহজে অনেকটা কমিয়ে আনতে পারেন। যেমন: স্মুথ মিউজিক, গভীর শ্বাস-ব্যায়াম, যোগব্যায়াম ইত্যাদি।
কন্সাল্টিং, থেরাপি, শেয়ারিং-এগুলো হচ্ছে মানসিক নির্যাতনের প্রভাবগুলি মোকাবেলার কয়েকটি উপায় মাত্র।
আপনি কখন পেশাদার কাউন্সেলিং এর সহায়তা নিতে পারেনঃ
সবকিছুর পরেও যখন আপনি সমস্ত সামাজিক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন বা উদ্বিগ্ন হওয়া ও হতাশার কারণে দায়িত্বগুলি পরিচালনা করতে অক্ষম তখনই প্রফেশনাল কাউন্সেলিং আপনার জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
পরিশেষে বলা যায়, মানসিক নির্যাতনের চাপ কমাতে পরিবারকে সময় দিন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন, নিজের শখের বিষয় নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। আত্ম-উন্নয়নে মনোনিবেশ করুন এবং অতীত নিয়ে না ভেবে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।
আরিফা জান্নাত ইভা/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ হেলথলাইন
+1
+1
2
+1
+1
+1
1
+1
+1
1