বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমের মধ্যে যে সমস্যাগুলি রয়েছে তার মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো এগুলো অনেক বেশি শক্তি খরচ করে। বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধান বের করার জন্য নিয়মিতই কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ সম্পাদন করে সেটি তারা রেকর্ড করার চেষ্টা করছেন।
তাদের আশা হয়তো প্রাকৃতিক কোনো সৃষ্টি তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। এই কারনেই বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের নিউরন যা মানব দেহের অন্যান্য অঙ্গগুলোকেও পরিচালনা করে, তা নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করছেন।
এখন এই বায়োলজিক্যাল মডেলটিকে অনুকরণ করে আরও নতুন কিছু মডেল আবিষ্কার হচ্ছে। সম্প্রতি চিপ এর জন্য বিখ্যাত কোম্পানি “ইন্টেল” পূর্ণাঙ্গ নিউরনের একটি চিপ উপস্থাপন করেছে যেখানে মানব মস্তিষ্ককে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নিউরোসাইন্সের অগ্রগতির মধ্যে আরেকটি বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম নিউরনের উন্নতি করেছেন এবং তারা সফলভাবে বায়োলজিক্যাল এবং আর্টিফিসিয়াল (কৃত্রিম) নিউরন অনলাইনের সাহায্যে সংযুক্ত করতে পেরেছেন।
মেলবোর্ন ভিত্তিক একটি অস্ট্রেলিয়ান স্টার্টআপ “কর্টিক্যাল ল্যাবস”, ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক তৈরির মাধ্যমে এই সমস্ত প্রচেষ্টা গুলোকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তারা বায়োলজিক্যাল নিউরন এবং বিশেষায়িত কম্পিউটার চিপের মাধ্যমে মডেলটি তৈরি করেছে। কোম্পানিটি গত বছর জুন মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তখন একটি স্বনামধন্য অস্ট্রেলিয়ান মূলধন সংস্থা কোম্পানিটিকে তহবিল হিসেবে ৬ লক্ষ ১০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার প্রদান করে।
শুরুতেই কর্টিক্যাল ল্যাবস এই অভিনব হার্ডওয়্যার তৈরির জন্য ২টি পদ্ধতি অনুসরণ করে। ১ম পদ্ধতিটি হলো ইঁদুরের ভ্রুন থেকে নেওয়া নিউরন ব্যবহার এবং ২য় পদ্ধতিটি হলো এমন একটি কৌশল যেখানে মানবত্বকের কোষগুলো মানব নিউরনে পরিবর্তিত করার আগে সেই কোষগুলোকে স্টেম কোষে রুপান্তর করা হয়।
পরবর্তী ধাপে এই নিউরন গুলোকে একটি বিশেষ মেটাল অক্সাইড চিপের উপর একটি পোষক তরল মিডিয়াম এর মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয় যা ২২,০০০ টি ক্ষুদ্র ইলেকট্রোড নিয়ে গঠিত। এই মেটাল অক্সাইড চিপ মূলত নিউরনে বৈদ্যুতিক ইনপুট ও ফলাফল পরিবহনকরতে সহায়তা করে।
অবশেষে তারা এই মিনি ব্রেইন বা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক তৈরি করতে সক্ষম হন। এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কটির প্রসেসিং ক্ষমতা একটি ফড়িং এর মস্তিষ্কের সমান হলেও এটি প্রাচীন অ্যাটারি গেম খেলতেও সক্ষম। বিখ্যাত কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক “ডিপমাইন্ড” তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদম প্রদর্শন করার জন্য ২০১৩ সালে এই গেমটি ব্যবহার করেছিল। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে গুগল এই কোম্পানিটিকে নিজের অধীনে নিয়ে নেয়।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একজন শীর্ষস্থানীয় স্নায়ুবিজ্ঞানী হলেন কার্ল ফ্রিস্টন। এই বছর তার মস্তিষ্ক ইমেজিং এর উপর ভিত্তি করে কর্টিক্যাল ল্যাবসের একটি প্রদর্শনীতে তার কাজের প্রতি সবাই মুগ্ধ। কর্টিক্যাল ল্যাবস এর গবেষণার কিছু দিক ফ্রিস্টনের গবেষনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
ফ্রিস্টন প্রত্যাশা করেছিলেন যে তার কাজটি আরও দক্ষ নিউরোমরফিক কম্পিউটার চিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হবে যেমন সম্প্রতি আমরা ইন্টেল কে দেখলাম। তবে তিনি স্ট্যান্ডার্ড কম্পিউটার চিপস এর সাথে বায়োলজিক্যাল নিউরন গুলোর সংযোগ এর ব্যাপারটি প্রত্যাশা করেননি এবং বলেন, “আমি যা ধারনা করতে পারিনি তা এই গ্রুপটি কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছে এবং ধারনাগুলিকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য এটিই সঠিক উপায়।”
যাই হোক, কর্টিক্যাল ল্যাবস-ই শুধুমাত্র বায়োলজিক্যাল কম্পিউটিং এর উপর কাজ করে এমন নয়। ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক একটি স্টার্টআপ “কনিকু”, একটি ৬৪-নিউরন ভিত্তিক সিলিকন চিপ তৈরি করেছে, এটি মূলত ইঁদুরের নিউরন ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এবং এটি নির্দিষ্ট কিছু কেমিক্যাল শনাক্ত করতে পারে।
তারা প্রত্যাশা করছেন যে, সামরিক ও আইন প্রয়োগকারীরা বিস্ফোরক সনাক্ত করতে তাদের আবিষ্কারটি ব্যবহার করতে পারে। এছাড়াও, এমআইটি–এর গবেষকগণ কম্পিউটিং সিস্টেম তৈরির জন্য হাইব্রিড চিপে ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইন ব্যবহার করে একটি উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আলফা–গো (AlphaGo), ডিপমাইন্ডের আবিষ্কৃত কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা ২০১৬ সালে সেই প্রাচীন অ্যাটারি খেলায় বিশ্বের সেরা মানব খেলোয়াড়কে পরাস্ত করেছিল। গেমটি খেলতে ১ মেগাওয়াট শক্তি ব্যবহার হয়েছিল যেখানে মানব মস্তিষ্কের সাহায্যে গেমটি খেলতে ২০ মেগাওয়াট শক্তির প্রয়োজন। যদিও এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বিস্ময়কর অর্জন ছিলো তবুও এই পুরো সিস্টেমটি চালনোর জন্য অঢেল পরিমান বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।
সুতরাং, কর্টিক্যাল ল্যাব যদি তাদের সাম্প্রতিক উদ্ভাবনকে কার্যকর করতে পারে তবে এটি ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী একটি সমাধান দিতে পারবে।
শামসুন নাহার প্রিয়া / নিজস্ব প্রতিবেদক