পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষ আছে। এক, যারা কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে গেলেই মশার কামড়ে অস্থির হয়ে ফিরে আসবে। আর দুই, যারা একই জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা থাকলেও মশা তাদের কে যেন দেখবেই না! কখনো চিন্তা করেছেন, ঠিক কোন কারণে মশা কিছু মানুষদেরকে বাকিদের তুলনায় একটু বেশিই পছন্দ করে? তাহলে কি মশাদের একটি নির্দিষ্ট ধরনের রক্ত পছন্দ? গবেষকদের মতে রক্তের গ্রুপই একমাত্র কারণ নয় যার জন্য এই ডানাওয়ালা পতঙ্গ মানুষের প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে থাকে। তাহলে মশা চুম্বক এর আসল রহস্যগুলো কি?
এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক যে মশা যখন কামড় বসিয়ে মানুষের রক্ত চুষে নেয় তখন ঠিক কি হয়।
যখন একটি স্ত্রী মশা কারো উপর এসে বসে তখন এটি তার প্রোবোসিস বা সুঁই সেই শরীরে মধ্যে প্রবেশ করায়। প্রোবোসিস হলো ছয়টি সূঁচের একটি ছোট মুখ যা ত্বকের ভেতর নিজেদের পথ খুঁজে নেয়। তাহলে মশা কামড়ালে সাথে সাথে টের পাওয়া যায় না কেন?
কারণ প্রবোসিসের বাহিরের দুটি সূঁচ করাত আকৃতির ব্লেডের মতো যা ত্বক ফুটো করে সম্পূর্ণ সূঁচ ভেতরে প্রবেশ করাতে সাহায্য করে। এর একটি নরম অংশ রয়েছে যা ত্বকে প্রথমে আঘাত করে এবং তারপর করাতের মতো অংশটি হালকা কম্পনের সাথে ত্বকে মিলিত হয় যাতে কম শক্তির প্রয়োজন হয়। আরেকটি কারণ হলো শেষের দুটির মধ্যে একটি সূঁচ রক্ত শুষে নেয় এবং অপরটি থেকে মশকী নিজের লালা আমাদের ত্বকের উপর নিঃসরণ করে। এই লালা মানব ত্বককে কিছুক্ষণের জন্য অবশ করে দেয়। ফলে মশার কামড় তাৎক্ষণিকভাবে টের পাওয়া যায় না।
এবারে মূল প্রসঙ্গে আসা যাক যে কেন মশারা কিছু নির্দিষ্ট মানুষকেই বারবার কামড়ায়?
কারো মতে এক্ষেত্রে ব্যক্তি কী খাবার বা পানীয় গ্রহণ করেছেন তা একটি ভূমিকা পালন করে। কেউ বলে যে গর্ভাবস্থা মশার আকর্ষণকে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া সংক্রামক জীবাণু উপস্থিত নাকি অনুপস্থিত এই বিষয়ও মশা সেই ব্যক্তিকে কামড় দিবে নাকি দিবে না তা প্রভাবিত করে।
মশা একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত বেশি পছন্দ করে কিনা তা এখনও গবেষকদের কাছে একটি বিতর্কিত বিষয়। তবে ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাকি গ্রুপের রক্তের তুলনায় O গ্রুপধারী ব্যক্তিদেরকে মশা বেশি কামড়ায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সকলে এই মতে এক হতে পারেন নি। বরং অধিকাংশ গবেষকদের মতে একজন “মশা চুম্বক” হওয়ার ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপের চেয়ে ব্যক্তির ত্বকের ঘ্রাণ এবং মাইক্রোবায়োটা বেশি ভূমিকা রাখে।
মাইক্রোবায়োটা কি?
এটি হলো মাইক্রোবায়োম নামে পরিচিত একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া এবং ছত্রাক। দেহের এমন সকল স্থান যেখানে মাইক্রোবায়োটা উপস্থিত, এর আশেপাশের অণুজীব, জিনোম এবং পরিবেশগত অবস্থা হলো মাইক্রোবায়োম। ত্বকের মাইক্রোবায়োম ত্বকের কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পেপটাইডগুলোকে ভেঙ্গে উদ্বায়ীতে পরিণত করে। ত্বকের মাইক্রোবায়োটার যেকোন পরিবর্তন এর ঘামের গঠন পরিবর্তন করে প্রায়শই স্বতন্ত্র গন্ধ উৎপন্ন করে যা মশারা আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারে।
২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায় যে এই ঘ্রাণের উপর ভিত্তি করে মশা ঠিক করে যে সে কার রক্ত নিয়ে আহার করবে। এই গবেষণায় মানব ত্বকের ফ্যাটি অ্যাসিডের (বিশেষত কার্বক্সিলিক অ্যাসিড যা সিবামের সাথে নিঃসৃত হয়) দিকে লক্ষ্য করা হয়। সিবাম হলো মোমযুক্ত, তৈলাক্ত পদার্থ যা ত্বককে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে। গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের সিবাম সংগ্রহের জন্য তাদের বাহুতে নাইলনের মোজা পড়িয়েছিলেন। একটি চেম্বারে সিবাম যুক্ত নাইলনগুলো স্থাপন করা হয়েছিল যেখানে Aedes aegypti মশা এখান থেকে যেকোন একটি নাইলন বেছে নিতে পারে। দেখা গেছে তীব্র এবং দুর্বল আকর্ষণকারীদের সিবামের যৌগের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। বেশ কয়েকটি কার্বক্সিলিক অ্যাসিড রয়েছে যা দুর্বল আকর্ষণকারীদের চেয়ে তীব্র আকর্ষণকারীদের ত্বকে বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে তীব্র আকর্ষণকারী ব্যক্তি তিনটি কার্বক্সিলিক অ্যাসিড- পেন্টাডেকানোইক (pentadecanoic), হেপ্টাডেকানোইক (heptadecanoic) এবং ননডেকানোয়িক (nonadecanoic) অ্যাসিড উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ মাত্রায় উৎপাদন করেন।
মশা চুম্বক মানুষের সিবামের যৌগগুলো বাকিদের থেকে আলাদা কেন?
ধারণা করা যায় যে প্রতিটা মানুষ জিনগত ভাবেই ভিন্ন সিবাম তৈরি করতে পারেন। ত্বকের মাইক্রোবায়োমের পার্থকের কারণেও উপস্থিত ফ্যাটিএসিড সমূহ আলাদা হতে পারে। জিনগতভাবেই কেউ মশাকে আকর্ষণ করে কিনা তা জানা যায় ২০১৫ সালে PLOS জার্নালে প্রকাশিত “জমজ সমীক্ষার” মাধ্যমে। এর ফলাফল মতে DNA -র কারণে প্রায় ৬৭% মশা আকর্ষিত হয়। দুইদল জমজ বোনদের উপর করা এ গবেষণায় দেখা যায়, যারা অভিন্ন জমজ (যাদের বাহ্যিক চেহারা এবং জিন সম্পূর্ণ এক) তারা ভাতৃপ্রতিম জমজদের (যেসকল জমজ ভাই-বোনের চেহারা আলাদা, কিন্তু জিন এক) তুলনায় মশাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে।
২০২৩ সালের মে মাসেই মশা চুম্বক ব্যক্তিদের নিয়ে আরো একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এবারে গবেষকরা আরেকটি সাধারণ মশকী প্রজাতি Anopheles gambiae নিয়ে গবেষণা করেন। তারা দেখতে পান মশকী গুলো বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে দৈহিক ঘ্রাণ এবং ঊষ্ণ তাপমাত্রার মানুষদের প্রতি। তারা আরো একবার প্রমাণ পেয়েছেন যে মশার কাছে কার্বক্সিলিক এসিডগুলো আকর্ষণীয় এবং বিকর্ষণীয় মানুষের গন্ধের মধ্যে পার্থক্যের বড় কারণ। কিন্তু এবারে তারা নতুন করে দেখতে পান যে বিউটারিক, আইসোবিউটারিক এবং আইসোভ্যালেরিক এসিডের উপস্থিতি মশাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে।
সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত যে সকল কারণে মশা মানুষের প্রতি আকর্ষিত হয় তা কখনও বদলাতে না পারলেও মশা চুম্বকদের জন্য সুখবর হলো এমন কিছু জিনিস আছে যা মশাকে বিকর্ষণ করে। প্রথমত বলতে হয় DEET এর কথা।
DEET হলো N, N-ডাইইনি থাইল-মেটা-টোলুয়ামাইডের রাসায়নিক নাম। এটি একটি বড় মশা নিরোধক। পরিধেয় পোশাকে DEET ব্যবহার করলে আশা করা যায় মশা ব্যক্তির থেকে দূরে থাকবে। এছাড়াও গবেষকরা দেখেছেন যে ইউক্যালিপ্টাস গাছের তেলের ঘ্রাণ মশাকে বিকর্ষণ করে। মশা চুম্বকদের জন্য Centers for Disease Control and Prevention এর উপদেশ হলো ফুল হাতা পোশাক এবং লম্বা প্যান্ট পরিধান করে বাহিরে বের হওয়া।
সবশেষে মশা চুম্বকরা নিজেদের এ বলে স্বান্তনা দিতে পারেন যে আর কেউ না হোক মশা তো আমায় ভালোবাসে।
শাহলীন রাহনুমা / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সাইটেকডেইলি, ফিজার
+1
+1
+1
2
+1
+1
+1
1
+1