আমরা পশু-পাখিদের রোগাক্রান্ত হবার পেছনে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকার কথা হরহামেশাই শুনে থাকি। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্লাস্টিক দ্বারা রোগাক্রান্ত হবার একটি ঘটনা উঠে এসেছে। একদল বিজ্ঞানী লর্ড হোয়ি নামক দ্বীপে Flesh-footed shearwater নামক পাখির উপর এ গবেষণা চালান। গবেষণায় প্লাস্টিকের কারণে পাখিদের রোগাক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। প্লাস্টিকের ফলে হওয়া এই নতুন রোগ-এর নাম প্লাস্টিকোসিস।
Natural History Museum এর বিজ্ঞানীদের মতে, “বন্যপ্রাণীদের মধ্যে প্লাস্টিকের ফলে ফাইব্রোসিস হবার ঘটনা এ-ই প্রথম শনাক্ত হলো।”
ফাইব্রোসিস কী?
যখন আমাদের দেহে কোন ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তখন ঐ ক্ষতটির ফলে হওয়া শূণ্যস্থানটি দ্রুততম পূরণের জন্য দেহ Scar tissue নামক একধরনের টিস্যু উৎপন্ন করে। এই টিস্যুগুলো ‘কোলাজেন’ নামক প্রোটিন দ্বারা তৈরি হয়। এদের মূল কাজ হল সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষতস্থানটির জায়গাটি দখল করে রাখা, যতক্ষণ না নতুন টিস্যু তৈরি হয়ে সেগুলোর জায়গা নিচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়াকে ফাইব্রোসিস বলা হয়।
ফাইব্রোসিসের ফলে ক্ষতস্থান ও তার আশেপাশে পুরু ও শক্ত দাগের সৃষ্টি হয়।
প্লাস্টিকোসিস কীভাবে হয়? এর লক্ষণ কি?
বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিকের ব্যবহার অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেলেও তার মধ্য থেকে শুধুমাত্র ৯%-ই পুনরায় ব্যবহার উপযোগী বা রিসাইকেল করা করা সম্ভব হয়েছে। বাকি প্লাস্টিকগুলো বর্জ্য হিসেবে চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য এ বর্জ্যের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছেই।
এ বর্জ্যের কিছু অংশ গিয়ে জীবদের খাদ্যশৃঙ্খলেও অনুপ্রবেশ করেছে। সামুদ্রিক পাখিদের ‘প্লাস্টিকোসিস’ মূলত এই প্লাস্টিক মিশ্রিত খাবার খাওয়ার ফলেই হয়। এ রোগটি মূলত অল্পবয়সী পাখিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। যখন অভিভাবক পাখিগুলো তাদের শিশুদের প্লাস্টিক মিশ্রিত খাবারগুলো খাওয়ায় তখন প্লাস্টিক কণাগুলো বাচ্চা পাখিগুলোর পরিপাক নালীতে ক্ষতের সৃষ্টি করে, যার ফলস্বরূপ সেখানে ফাইব্রোসিস ঘটে।
কিন্তু প্লাস্টিক কণাগুলো প্রতিনিয়ত পরিপাকনালীতে এরূপ ক্ষত তৈরি করতে থাকে। বিশেষ করে পাখিগুলোর দেহের ‘প্রোভেন্টিকুলাস‘ নামক অংশে প্লাস্টিকের ফলে হওয়া ফাইব্রোসিসের চিহ্ন বেশি দেখা যায়, যা পাখিগুলোর পরিপাক কাজে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ পাখিদের পরিপাক কাজ মূলত ‘প্রোভেন্টিকুলাস’ থেকেই শুরু হয়।
গবেষণাটিতে জড়িত বিজ্ঞানীদের মতে,
“পাখিগুলোকে বাইরে থেকে দেখতে সুস্থ মনে হলেও, ভিতরে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা মোটেও ভালো নয়।”
তবে একটি প্রশ্ন চাইলে করাই যায়, গবেষকগণ কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, পরিপাকনালীর এ ক্ষতচিহ্ন গুলোর পেছনে শুধু প্লাস্টিক-ই দায়ী?
পাখিগুলোর পেটের মধ্যে পাওয়া পদার্থগুলোর মধ্যে প্লাস্টিকের পাশাপাশি বিভিন্ন পাথরও পাওয়া যায়। কিন্তু গবেষণার পর দেখা যায়, প্লাস্টিকের কারণে পরিপাকনালীতে দাগ দেখা দিলেও পাথরগুলোর ফলে কিন্তু এমন কিছুই হয়না। যার কারণে বিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, এ রোগটির পেছনে শুধুমাত্র প্লাস্টিক-ই দায়ী।
আরও পড়ুনঃ মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে মায়ের বুকের দুধেও!
প্লাস্টিকোসিসের নেতিবাচক প্রভাব?
আপাতত খাদ্যে থাকা প্লাস্টিকের ফলে হওয়া এই নতুন রোগ প্লাস্টিকোসিস শুধুমাত্র Flesh-footed shearwater এর মধ্যে পাওয়া গেলেও, যে পরিমাণে প্লাস্টিকের দূষণ বাড়ছে, তাতে অন্যান্য প্রজাতির পাখিদের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু এ রোগ পরিপাকনালীর ক্ষতি করে, তাই এ রোগে আক্রান্ত পাখিরা ঠিকমতো খেতে পারেনা। ফলে খাদ্যাভাবে অনেক পাখি, বিশেষ করে শিশুগুলো মারা যায়। তাছাড়া পরিপাকনালীর পাশাপাশি পাখিগুলোর কিডনি ও প্লীহাতেও প্লাস্টিক কণা পাওয়া গিয়েছে।
এটি পাখিদের জন্য তো বটেই, অন্যান্য সকল প্রাণীদের জন্য একটি অশনি সংকেত।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, oecd.org, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক, সায়েন্স ডিরেক্ট
নিজস্ব প্রতিবেদক/ আতিক হাসান রাহাত