পানি সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আপনার দেহের জন্য কি পরিমান পানি পান করা প্রয়োজন এবং পানির উপকারিতা কি সেই সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকতে হবে।
আচ্ছা আমরা কি জানি আমাদের প্রতিদিন কতটুকু পরিমান পানি পান করা উচিত? প্রশ্নটি সহজ হলেও উত্তর টি একটু কঠিন বটে!
কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনেকবছর যাবত গবেষণা করে কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। একজন মানুষের কি পরিমাণ পানি পান করা উচিত সেটি আসলে অনেক গুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে যেমনঃ আপনার স্বাস্থ্য, আপনার কাজের সক্রিয়তা এবং আপনি কোথায় বসবাস করেন ইত্যাদি।
একেকজনের দেহের উপর একেকরকম ফর্মুলা প্রযোজ্য যার কারনে একটি ফর্মুলা সবার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে না। প্রকৃতপক্ষে আপনার দেহের গঠনের উপর নির্ভর করবে কি পরিমাণ পানি আপনার জন্য প্রয়োজন।
সুস্বাস্থ্যের জন্য পানির উপকারিতাঃ
পানি আমাদের দেহের প্রধান রাসায়নিক উপাদান এবং দেহের ওজনের ৬০ ভাগই পানি। আমাদের দেহ পানির উপর নির্ভর করেই টিকে থাকে। দেহের প্রত্যেক কোষ, টিস্যু/কলা এবং অন্যান্য অঙ্গ– প্রত্যঙ্গ সঠিকভাব কাজ করার জন্য পানি প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপঃ
- মূত্রের মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থের নিষ্কাশনে
- দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে
- সংবেদনশীল টিস্যু/কলা সমূহকে রক্ষা করতে ইত্যাদি
পানির অভাবে অনেক সময় ডিহাইড্রেশন দেখা যায়। ডিহাইড্রেশন এমন একটি অবস্থা যার ফলে আমাদের দেহ মাঝে মধ্যে ভারসাম্য এবং কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় সামান্য পানির অভাবেও দেহ প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না এবং অনেক ক্লান্ত অনুভূত হয়।
কি পরিমান পানি আপনার দেহের জন্য প্রয়োজন?
প্রতিদিনই আমরা কোনো না কোনো ভাবে দেহ থেকে পানি হারিয়ে ফেলি যেমন শ্বাস–প্রশ্বাস, রেচন, ঘর্ম/ঘাম বা অন্ত্রের বিভিন্ন কাজে। সেই জন্য দেহের কার্যকারিতা রক্ষার জন্য আপনাকে প্রচুর পানি পান করতে হবে। এখন কথা হলো যে, আপনার দেহের জন্য আসলে কি পরিমান পানি প্রয়োজন? এটি মূলত তাপমাত্রা, জলবায়ু ইত্যাদির উপরও নির্ভর করে। প্রকৃতপক্ষে ‘দ্যা ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিসিন‘ নির্ধারন করেছে দৈনিক পর্যাপ্ত কি পরিমান পানি প্রয়োজন।
- পুরুষের ক্ষেত্রে – আনুমানিক ১৫.৫ কাপ (৩.৭ লিটার)
- মহিলাদের ক্ষেত্রে– আনুমানিক ১১.৫ কাপ (২.৭ লিটার)
নিরাপদে হাইড্রেটেড থাকাঃ
দেহে তরলের চাহিদা পূরণের জন্য আপনাকে শুধু পানির উপর নির্ভর করতে হবে না। আপনি যা খাচ্ছেন যেমন বিভিন্ন ফল, শাক–সবজি ইত্যাদির মধ্যে প্রায় ১০০ ভাগ পর্যন্ত পানি থাকে। কিন্তু আপনি তখনই পর্যাপ্ত পানি পান করবেন যখন–
- আপনি তৃষ্ণার্ত অনুভব করবেন
- আপনার মূত্র যখন বিবর্ন বা হালকা হলদেটে ভাব ধারণ করবে
একজন ডাক্তার বা একজন ডায়েটেশিয়ান–ই আপনাকে পরামর্শ দিতে পারবে আসলে কি পরিমান পানি আপনার দেহের জন্য প্রয়োজন।
উপরন্তু কিছু পানীয় যেমন দুধ, জুস, হারবাল চা ইত্যাদিও পানি দ্বারাই তৈরি। অর্থাৎ পানির পাশাপাশি আপনি এগুলো গ্রহন করতে পারেন। এছাড়া পানিশূন্যতা প্রতিরোধের জন্য আপনি পানির পাশাপাশি কম ক্যালরিযুক্ত ড্রিংকস বা বেভারেজও বেছে নিতে পারেন। তাছাড়া আপনি যা যা করতে পারেন–
- খাবার খাওয়ার সময় কম ক্যালরিযুক্ত বেভারেজ গ্রহন করতে পারেন
- ব্যায়ামের পূর্ববর্তী, মধ্যবর্তী এবং পরবর্তী অবস্থায় পানি গ্রহণ করতে পারেন
- যখনই আপনি ক্ষুধার্ত অনুভব করবেন তখনই পানি পান করতে পারেন
তবে আরেকটি ব্যাপার হলো আপনার কিডনি যখন রেচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে না এবং সোডিয়াম যখন রক্তের সাথে মিশে পাতিত হয়ে যায় তখনও আপনি তৃষ্ণার্ত অনুভব করতে পারেন। এটি হাইপোনেট্রেমিয়া নামে পরিচিত যা আপনার জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
যেসব বিষয়গুলো পানির চাহিদাকে প্রভাবিত করেঃ
আপনার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে পানি গ্রহণের পরিমান হয়ত পরিবর্তন হতে পারে–
ব্যায়ামঃ আপনি যদি এমন কোনো কাজ করেন যা আপনাকে ঘাম ঝরাতে বাধ্য করে সেক্ষেত্রে আপনাকে প্রচুর পরিমান পানি পান করতে হবে।
পরিবেশঃ গরম বা আর্দ্র আবহাওয়া আপনাকে ঘর্মাক্ত করে তুলবে তাই আপনাকে বেশি বেশি পানি পান করতে হবে। এছাড়া ডিহাইড্রেশনও উচ্চ মাত্রায় ঘটতে পারে।
প্রেগন্যান্সি ও ব্রেস্ট ফিডিংঃ প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন বা ব্রেস্ট ফিডিং এর সময় মহিলাদের হাইড্রেটেড থাকার জন্য অতিরিক্ত তরল প্রয়োজন। নারী স্বাস্থ্য দপ্তর সুপারিশ করছে যে মহিলাদের প্রতিদিন প্রায় ১০ কাপ (২.৪ লিটার) তরল পান করতে হবে এবং যেসব মায়েরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়ান তাদের প্রতিদিন ১৩ কাপ (৩.১ লিটার) তরল গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়াও বেশি বেশি পানি গ্রহণের ফলে আপনি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রতিরোধ সক্ষম হবেনঃ
- কোষ্ঠকাঠিন্যঃ বেশি পানি গ্রহণের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে।
- ক্যান্সার প্রতিরোধঃ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যারা বেশি পানি পান করেন তাদের মূত্রাশয়ে এবং কলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুকি কম থাকে যদিও অন্যান্য গবেষণায় এর কোনো প্রভাব পাওয়া যায় নি।
- কিডনি পাথরঃ পানি গ্রহন বৃদ্ধি কিডনিতে পাথরের ঝুঁকি কমাতে পারে।
পানি গ্রহনের ফলে কি এনার্জি লেভেল বা ব্রেইন কার্যকারিতায় কোনো প্রভাব আছে?
অনেক মানুষই বলে আপনি যদি দিনে বেশি বেশি পানি পান না করেন তাহলে আপনার এনার্জি লেভেল এবং ব্রেইন এর ফাংশনগুলোর কার্যকারিতায় সমস্যা দেখা যাবে। এবং অনেক গবেষক এটি সমর্থন করেন।
একটি গবেষনায় দেখা যায় যে মহিলারা যখন ব্যায়াম করেন তখন দেহে পানির ঘনত্ব ১.৩৬ ভাগ কমে যায় এবং মাথা ব্যাথার সৃষ্টি হয়।
আরেকটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, সামান্য পরিমাণ পানিশূন্যতাও ব্রেইন ফাংশনগুলোর জন্য ক্ষতিকর। তবে সবসময় মাথায় রাখবেন যে দেহের ১ ভাগ পানির পরিমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং আপনি যখন অনেক ঘর্মাক্ত থাকেন, সেই ঘামের পরিমান টি হলো এই ১ ভাগ পানি।
বেশি পানি পান করলে কি ওজন কমে?
অনেকেই দাবি করেন বেশি পরিমান পানি গ্রহণ করলে হয়তো দেহের ওজন অনেকাংশে হ্রাস পায় যেটি মূলত ঘটে থাকে পরিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধির ফলে এবং ক্ষুধা নিবারনের ফলে।
দুটি গবেষণার মতে, ১৭ আউন্স বা ৫০০ মিলি পানি সাময়িক সময়ের জন্য পরিপাক ক্রিয়া ২৪–৩০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে।গবেষকগণ অনুমান করেন একদিনে ৬৮ আউন্স বা ২ লিটার পানি আপনার দেহের প্রায় ৯৬ ক্যালরি বার্ন (Burn) করতে পারে।
খাবার গ্রহনের আধঘন্টা আগে পানি পান আপনার ক্যালরি গ্রহণের পরিমান হ্রাস করতে সক্ষম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ডায়েট করার জন্য খাবারের পূর্ববর্তী আধঘন্টা আগে পানি গ্রহণ করেন তারা ১২ সপ্তাহের মধ্যে ৪৪ ভাগ ওজন হ্রাস করতে পেরেছেন।
অর্থাৎ, সর্বোপরি এইটুকুই বলা যায় যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পানির বিকল্প কিছু নেই।
তাই তো “পানির অপর নাম জীবন“
শামসুন নাহার প্রিয়া/ নিজস্ব প্রতিবেদক