আমদানি রপ্তানি বা বিদেশভ্রমণ নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করতে অবৈধ ও ক্ষতিকর পণ্য বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সকল বন্দরে বিভিন্নভাবে চেকআপ করা হয়। যেমন: ফুল বডি স্ক্যানিং, লাগেজ স্ক্যানিং, এক্সরে স্ক্যানিং ইত্যাদি।
বিদেশ ভ্রমণের সময় যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু পণ্য বহন করার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। যেমন দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থ, ধারালো অস্ত্র, কিছু ধরনের ইলেকট্রিক্যাল পণ্য, মাদক দ্রব্য ইত্যাদি। বিমানবন্দরে বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা তল্লাশির মাধ্যমে যাত্রীদের মধ্যে অনিরাপদ পণ্য থাকলে তা শনাক্ত করা হয়।
সাধারণত স্ক্যানিং মেশিনগুলো এক্সরে পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করে। এক্সরে পদ্ধতিতে এক্সরে মেশিন একধরনের তড়িৎ চুম্বকীয় রশ্মি নির্গত করে যা বিভিন্ন শনাক্তকারী বস্তুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। তবে কনভেয়র বেল্ট স্ক্যানিং-এ সাধারণ এক্সরে এর তুলনায় অনেক শক্তিশালী এক্সরে ব্যবহার করা হয় তাই অনেক বেশি পণ্যের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
বিমানবন্দর বা পণ্য চালানের সময় সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি হয় যখন সন্দেহজনক কোনো কিছু লক্ষ্য করা হয়। কাস্টমস কর্মকর্তারা যদি স্ক্যানিং এর সময় সন্দেহজনক কোনো কিছু লক্ষ্য করেন তখন নিশ্চিত হওয়ার জন্য লাগেজ বা ব্যাগ খুলে চেক করেন অথবা শনাক্তকরণ কুকুর দ্বারা চেক করেন। কারণ এক্সরে স্ক্যানিং করার সময় সম্পূর্ণ পণ্যের ছবি দেখা যায় না, বরং একটা প্রতিবিম্ব বা ছায়ার মত তৈরি হয়।
সম্প্রতি এক আবিষ্কারের মাধ্যমে আশা করা যাচ্ছে এই বিব্রতকর পরিস্থিতির ইতি টানা সম্ভব। স্মিথ ডিটেকশন নামে এক নিরাপত্তা স্ক্যানিং প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানি SDX 10060 XDi নামে একটি স্ক্যানিং মেশিন চালু করেন। যার মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের ব্যাগ বা পণ্যের কনটেইনার না খুলেই পণ্য শনাক্ত করা যাবে।
লন্ডনভিত্তিক এই কোম্পানির মতে,
“এই মেশিনটি সীমান্ত পুলিশিং এর ক্ষেত্রে গেইম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে, যা নিরাপত্তা বাহিনীর অর্থ ও সময় বাঁচাতে সাহায্য করবে।”
এই মেশিনটি এক্সরে ডিফ্র্যাকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্তমানে তিন ধরনের এক্সরে স্ক্যানিং পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে:
১. ট্রান্সমিশন এক্সরে
২.কম্পিউটার টোমোগ্রাফী
৩. এক্সরে ডিফ্র্যাকশন
ট্রান্সমিশন এক্সরে এর ক্ষেত্রে শনাক্তকরণ যন্ত্র থেকে নির্গত এক্সরে রশ্মি মানবদেহ বা যেকোনো বস্তু কর্তৃক শোষিত হয়ে অপর প্রান্তে প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। এক্ষেত্রে এক্সরে মেশিনটি সোজাসুজি ভাবে রশ্মি নির্গত করে তাই শনাক্তকারী বস্তুর দ্বিমাত্রিক ছবি তৈরি হয়।
আবার কম্পিউটার টোমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যানার এর ক্ষেত্রে নলাকৃতির মেশিন থেকে নির্গত এক্সরে রশ্মি মানবদেহ বা বস্তু কর্তৃক শোষণ করে প্রতিবিম্ব তৈরি করে। সিটি স্ক্যানারের ক্ষেত্রে মেশিনের ঘূর্ণনের ফলে অনেকগুলো দ্বিমাত্রিক ছবি জমা হয়। জমাকৃত ছবিগুলো থেকে স্ক্যানার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে একটি ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে।
কিন্তু এক্সরে ডিফ্র্যাকশন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পদ্ধতি। এক্সরে ডিফ্র্যাকশন হল অত্যন্ত শক্তিশালী শনাক্তকরণ পদ্ধতি, যেখানে কোনো বস্তুর উপর স্ক্যানার চালনা করলে এক্সরে গুলো বিভিন্ন অনুপাতে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ার অনুপাতের উপর ভিত্তি করে বস্তু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয়।
সাধারণ এক্সরে বস্তুর আকার আকৃতির উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত দেয়। তাই বিভিন্ন বস্তুর আকৃতি একই রকম মনে হলে সাধারণ এক্সরে অনেক সময় ভুল অ্যালার্ম দিয়ে দেয়। এতে করে যাত্রীদের হেনস্তার শিকার হতে হয়।
অন্যদিকে এক্সরে ডিফ্র্যাকশন বস্তুর আণবিক গঠনের উপর ভিত্তি করে বস্তু শনাক্ত করে। বস্তুর আণবিক স্তরে এক্সরে এর কতটুকু ব্যতিচার ঘটে তার উপর ভিত্তি করে প্রতিটি বস্তু একটি অনন্য প্যাটার্ন তৈরি করে।
এই প্যাটার্নটি একটি বস্তুকে নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এক্সরে ডিফ্র্যাকশন প্রায় একই রকম দেখতে বা একই ঘনত্বের বস্তুর মধ্যে অত্যন্ত নিখুঁত পার্থক্য করতে পারে। বিশেষ করে পাউডার জাতীয় বা তরল পদার্থ শনাক্তকরণে এই পদ্ধতি বেশ উপযোগী।
স্মিথ ডিটেকশন এর প্রেসিডেন্ট জেরোম দ্যা চ্যাসীর ভাষায়,
“বিস্ফোরক শনাক্তকরণ মেশিনে অটোমেটেড অ্যালার্ম সিস্টেম থাকায়, এই প্রযুক্তি কয়েকস্তর বিশিষ্ট ব্যাগ এবং এয়ার কার্গো স্ক্রিনিং এ নিজে নিজে বিশ্লেষণ করে সতর্ক করতে পারে। যার ফলে বিমানবন্দরে স্ক্যানিংয়ে কর্মদক্ষতা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি করে ও খরচ কমিয়ে আনতে পারে।”
মেশিনগুলোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়্যার রয়েছে যা নতুন পণ্যের সাথে পরিচিত হতে ও পদার্থের বৈচিত্র্য শনাক্ত করে প্রতিনিয়ত আপডেট করতে পারবে।এই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তির ব্যবহারে সবচেয়ে ভালো ফলাফল আসবে মাদক চোরাচালান রুখে দিতে।
এর নির্ভুল শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া, যথাযথ পার্থক্যকরণ, দ্রুত গতির কার্যসম্পাদন, পাউডার বা তরল অথবা কঠিন যেকোনো ধরনের মাদক শনাক্ত করতে পারে। এছাড়া গবেষকরা আশা করেন, বিপদজ্জনক পরিস্থিতিতে শনাক্তকরণ কুকুর দ্বারা শনাক্ত করার প্রক্রিয়াও কমে আসবে। ইতিমধ্যে বিশ্বের ব্যস্ততম প্রায় ৫০ টি বিমানবন্দরে এই প্রযুক্তি স্থাপনের জন্য ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।
মোহাম্মদ রিফাতুল ইসলাম মারুফ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: টেলিগ্রাফ, স্মিথডিটেকশন