গর্ভনিরোধের একটি জনপ্রিয় এবং কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে জন্মনিরোধক পিল। এই পিলের সাফল্যের হার বেশি তবে অনেক সময় ব্যর্থও হতে পারে এবং আপনি পিল খাওয়া অবস্থায়ও গর্ভবতী হতে পারেন। এর পিছনে কিছু কারণ আছে, যেমন পিল মিস করা, বমি হওয়া এবং কিছু ওষুধ গ্রহণে পিলের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি এবং তা অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের কারণ হতে পারে।
আপনি যদি যৌন সম্পর্কে সক্রিয় থাকেন এবং অপরিকল্পিত গর্ভাবস্থা রোধ করতে চান তবে কিছু বিষয় সম্পর্কে আপনার সর্তক থাকতে হবে।
আজ আলোচনা করব এমনই কিছু বিষয় যেমনঃ
* জন্মনিরোধক পিল কতটা কার্যকর এবং কীভাবে পিলটি ব্যর্থ হতে পারে এর কিছু কারণ
* আমরা কীভাবে পিলের ব্যর্থতা রোধ করতে পারি ও সে সম্পর্কিত কিছু টিপস এবং
* গর্ভাবস্থার কিছু প্রাথমিক লক্ষণ।
জন্মনিরোধক পিল কতটা কার্যকর?
কম্বাইন্ড পিলে থাকা হরমোনগুলো ডিম্বস্ফোটন (Ovulation) প্রতিরোধ করে। মিনিপিল নামে পরিচিত আরেক ধরনের পিল আছে যা ব্যক্তির জরায়ুর শ্লেষ্মা ঘন এবং জরায়ুর আস্তরণ পাতলা করে দেয়, ফলে ডিম্বাণুর মধ্যে বীর্যপাতের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
কোন ব্যক্তি যদি পিল সঠিকভাবে গ্রহণ করে এবং কোন পিল মিস না করে তবে জন্মনিরোধক পিল খুব কার্যকর। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রসমূহের (সিডিসি) মতে, পিলটি নির্ভুল ব্যবহারের ফলে তা ৯৯.৭% কার্যকর হয়। অর্থ্যাৎ ১ বছর পিল গ্রহণ করেছেন এমন ১০০ মহিলার মধ্যে ১জনেরও কম গর্ভবতী হবে।
তবে, নিয়মিত ব্যবহারের সাথে পিলের কার্যকারিতা হয়ে যায় প্রায় ৯১%। এর অর্থ এই যে, এক বছর একটানা এই পিল গ্রহণ করেছেন এমন ১০০ জনের মধ্যে ৯ জন গর্ভবতী হবে।
পিল ব্যর্থতার পাঁচটি কারণ:
যদিও জন্ম নিয়ন্ত্রণে পিল খুব কার্যকর তবে কিছু পরিস্থিতি এর কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে এবং কখনও কখনও অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের কারণও হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- একদিন মিস করা
পিল নির্মাতারা চান, সবচেয়ে কার্যকর ফল পাওয়ার জন্য লোকেরা প্রতিদিন পিল গ্রহণ করুক। যদি কোন ব্যক্তি এক দিন মিস করে তবে গর্ভাবস্থা রোধ করতে তাদের হরমোনের মাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ পর্যায়ে থাকতে পারে না।
কোন ব্যক্তির দৈনিক ভিত্তিতে পিল নিতে অসুবিধা হলে অন্যান্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলি তাদের প্রয়োজনের সাথে আরও ভাল মানিয়ে নিতে পারে। একজন ডাক্তার বা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ থেকে বিকল্প গর্ভনিরোধকের পরিসীমা সম্পর্কে পরামর্শ নিতে পারেন।
- বমি করা
অনেক সময় পিল গ্রহণ করার সময় কোন ব্যক্তি অসুস্থ হতে পারে। যখন কোন ব্যক্তি বমি করে, তখন পিলটি বেরিয়ে আসতে পারে, বা এটি তার দেহে পুরোপুরি শোষণ নাও হতে পারে।
যদি কোন ব্যক্তি পিল গ্রহণের অল্পক্ষণের মধ্যেই বমি করে ফেলে, তবে তার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্য একটি পিল গ্রহণ করা উচিত এবং পরের পিলটিও যথারীতি গ্রহণ করা উচিত।
- প্রতিদিন একই সময়ে পিল গ্রহণ না করা
প্রতিদিন জন্মনিরোধক পিল গ্রহণের পাশাপাশি, একজন ব্যক্তির প্রতিদিন একই সময়ে পিল নেওয়া উচিত। এটি তাদের হরমোনের মাত্রা আরও ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখতে পারে।
একজন ব্যক্তির প্রতিদিন একই ৩ ঘন্টা টাইম রেঞ্জের মধ্যে সর্বদা মিনিপিল নেওয়া উচিত। কেউ যদি এই টাইম রেঞ্জ মিস করে, তার পরবর্তী ২ দিনের জন্য একটি ব্যাকআপ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা বা যৌনমিলন এড়ানো উচিত।
চাইলে একটি দৈনিক অ্যালার্ম সেট করতে পারেন যা প্রতিদিন সঠিক সময়ে পিল নেওয়ার জন্য মনে করিয়ে দেবে।
- এখনই নতুন প্যাক শুরু না করা
আগেরটি শেষ হওয়ার পর নতুন আরেক প্যাক পিল শুরু করা অপরিহার্য। তবে, অনেক সময় কোন ব্যক্তির নতুন প্যাক নাও থাকতে পারে। দুইটি প্যাকের মধ্যে কয়েক দিন পিল মিস করলে গর্ভাবস্থা রোধে পিলের কার্যকারিতা কমে যায়।
সিডিসির মতে, যে টানা দুটি বা ততোধিক পিল মিস করে তাদের ব্যাকআপ গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত বা পর পর ৭ দিন জন্ম নিরোধক পিল গ্রহণ না করা পর্যন্ত যৌনমিলন এড়ানো উচিত।
- কিছু ওষুধ পিলের কার্যকারিতা কমায়
কিছু ওষুধ পিলের কার্যকারিতা কমাতে পারে। ওষুধগুলির মধ্যে কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক যেমন রাইফ্যাম্পিসিন (Rifampicin) এবং গ্রিজোফুলভিনের (Griseofulvin)মতো অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ড্রাগগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই ওষুধগুলি গ্রহণ করার সময় এবং কোর্স শেষ করার পর ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত একজন ব্যক্তির ব্যাকআপ গর্ভনিরোধক ব্যবহার করা উচিত।
অন্যান্য আরও দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ এবং পরিপূরক রয়েছে যা জন্ম নিরোধক পিলের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- মৃগী রোগের ড্রাগগুলি যেমন ফেনোবারবিটাল (phenobarbital), ফে
নাইটোইন (phenytoin) এবং কার্বামাজেপাইন(carbamazepine) - এইচআইভি (HIV) চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ।
- সেন্ট জনস ওয়ার্ট (St. John’s Wort), যা একটি ভেষজ প্রতিকার।
পিলের ব্যর্থতা রোধ করার জন্য টিপস:
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খুব কার্যকর যদি কোন ব্যক্তি সেগুলিকে সঠিকভাবে গ্রহণ করে এবং কোন পিল মিস না করে। নিম্নলিখিত টিপসগুলি পিল খাওয়া অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত গর্ভাবস্থা রোধ করতে সহায়তা করতে পারে:
১. প্যাকেজিং পড়া এবং সাবধানে নির্দেশাবলীগুলো অনুসরণ করা।
২. প্রতিদিন একই সময়ে পিল গ্রহণ করা।
৩. এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যা পিরিয়ডগুলি ট্র্যাক করে এবং পিলের অনুস্মারক (Reminder) সরবরাহ করে।
৪. সর্বশেষ পিল প্যাকটি ফুরিয়ে যাওয়ার কমপক্ষে ১ সপ্তাহ আগে একটি নতুন প্যাক কিনে রাখা।
৫. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিস করা পিল গ্রহণ করা।
৬. কনডম জাতীয় গর্ভনিরোধক ব্যাকআপ পদ্ধতিরূপে ব্যবহার করা, যদি কোন ব্যক্তি পরপর দুটি বা ততোধিক পিল মিস করেন।
যদি কোন ব্যক্তি নিয়মিত পিল গ্রহণে সর্তক থাকতে না পারেন, তবে তাদের অন্যান্য জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের চিকিৎসক বা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে হবে।
এমন বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে যার জন্য প্রতিদিন পিল গ্রহণের প্রয়োজন হয় না,যেমন ইন্ট্রাইউটারিন ডিভাইস(intrauterine device) বা IUD.
গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণসমূহ:
যদি কোন ব্যক্তি গর্ভনিরোধকের ব্যর্থতা এবং গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হন, তবে তাদের অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে। তবে কিছু প্রাথমিক লক্ষণও রয়েছে যা গর্ভাবস্থা নির্দেশ করতে পারে:
১. ফুলে যাওয়াঃ যদিও ফোলাভাব প্রায়শই প্রাকস্রাবকালীন সিনড্রোমের লক্ষণ হয় তবে এটি কখনও কখনও গর্ভাবস্থার প্রথম দিকের লক্ষণও হতে পারে।
২. স্তনের কোমলতাঃ ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণ বাড়ার ফলে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে স্তনের কোমলতা দেখা দিতে পারে। কিছু মহিলার মধ্যে লক্ষণগুলি যেমন: টিংগলিং,ভারী হওয়া বা স্তন পূর্ণতা এমন অনুভূত হতে পারে।
৩. হাল্কা স্পটিংঃ একটি ডিম্বাণু জরায়ুর আস্তরণের সাথে সংযুক্ত হলে অল্প পরিমাণে রক্তপাত বা দাগ দেখা দিতে পারে। যদি প্রত্যাশিত পিরিয়ডের সময়ের বাইরে দাগ দেখা দেয় তবে এটি গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
৪. অব্যক্ত ক্লান্তিঃ গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনীয় পরিবর্তনগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে একজন ব্যক্তিকে ক্লান্ত করতে পারে।
৫.বেশিবার প্রস্রাব করাঃ হরমোনের পরিবর্তনগুলি গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে একজন মহিলার প্রস্রাব করার প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
যদি কেউ মনে করেন যে আপনার গর্ভবতী হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, তবে আপনি ঘরে বসে গর্ভাবস্থার পরীক্ষা করে নিতে পারেন।
অতএব অন্যান্য ওষুধের মতো জন্মনিরোধক পিল গ্রহণেরও কিছু নিয়ম রয়েছে। পিলের কার্যকারিতা বজায় রাখতে এবং অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ এড়াতে আপনাকে অবশ্যই নিয়মগুলো অনুসরণ করতে হবে। পিল গ্রহণে নিয়মিত হতে না পারলে আপনি অন্য কোন জন্ম নিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। অন্যথায় আপনার গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তানজিনা সুলতানা শাহীন / নিজস্ব প্রতিবেদক