চিনি শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এটি মূলত কার্বোহাইড্রেট যা আমাদের শরীরে গ্লুকোজ হিসেবে শোষিত হয়। প্রোটিন, ফ্যাট এর তুলনায় কার্বোহাইড্রেট থেকে সহজেই আমরা শক্তি পাই। আমাদের ব্রেইনের ভালোভাবে কাজ করতে প্রতিদিন ১৩০গ্রাম শর্করা (গ্লুকোজ) প্রয়োজন।
তবে চিনি খাওয়া নিয়ে আমাদের মাঝে ভীতির শেষ নেই। যদিও অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি গ্রহণ স্থূলতা, হার্ট এবং লিভারজনিত সমস্যার কারণ কিন্তু আমরা পরিমিত পরিমাণে খাওয়াকেও শরীরের জন্য অনেক খারাপ মনে করি। কিন্তু সত্য এটাই যে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য শর্করা প্রয়োজন।
আজ চিনি সম্পর্কে এমন সব মিথ নিয়ে আলোচনা করব, যা জেনে আপনিও আশ্চর্য হবেন। আলোচনায় যাওয়া যাক।
- মিথ-০১ঃ বেশি পরিমাণে চিনি খাওয়া ডায়াবেটিস এর কারণ
ডায়াবেটিস টাইপ-১, টাইপ-২ উভয়ই হয়ে থাকে মিশ্রিত কিছু জেনেটিক এবং পরিবেশগত ফ্যাক্টর এর কারণে। সেখানে চিনি একাই ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ নয়।
অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণ আর অন্যদিকে উচ্চ মাত্রায় শর্করা (গ্লুকোজ) গ্রহণ অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। তাই মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াই ডায়াবেটিস হওয়ার একমাত্র কারণ ভাবলে ভুল হবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য মিষ্টি খাবার সরাসরি দায়ী নয় আর টাইপ-১ ডায়াবেটিসের জন্য তো আপনার ডায়েট, জীবনধারা এসব কোনো ভূমিকাই রাখে না।
- মিথ-০২ঃ আপনার জন্য এক প্রকার চিনির চেয়ে অন্য প্রকার চিনি ভালো (যেমন ব্রাউন সুগারকে হোয়াইট সুগারের চেয়ে ভালো ধরা হয়)
সব ধরনের চিনি আপনার শরীরে একই প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন ধরনের চিনি রয়েছে, এ ধারণাটাই ভুল। লাল বা সাদা চিনি বা মধু সব ধরনের চিনি ভেঙ্গেই শুধু এক ধরনের উপাদানই তৈরি হয়-তা হল গ্লুকোজ। চিনি বলতেই সব কর্বোহাইড্রেট যা আমাদের শরীরে গ্লুকোজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- মিথ-০৩ঃ চিনি বাচ্চাদের হাইপারএক্টিভ (hyperactive) করে তোলে
গবেষকদের মতে, এটা সবচেয়ে হাস্যকর একটি মিথ। তাদের মতে, চিনি এবং হাইপারএক্টিভির মধ্যে সরাসরি নূন্যতম সম্পর্কও নেই।
আমাদের মতে, বাচ্চাদের ক্যান্ডি দিলে তাদের দিয়ে সব কাজ করানো সম্ভব। কিন্তু সত্যিটা হলো মিষ্টি বাচ্চাদের হাইপারএক্টিভিটি বাড়ায়- এমন কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
জানি এটাকে মিথ হিসেবে নিতে অনেকের কষ্ট হবে। মিষ্টি খাবার বাচ্চাদের আচরণে কোন প্রভাব ফেলে না, এটাই সত্য। নিজেকে স্পষ্ট করতে আরও রিসার্চ করতে পারেন।
- মিথ-০৪ঃ চিনি ক্যাভিটিস (cavities) সৃষ্টি করে।
ক্যাভিটিস সৃষ্টি হয় এসিডিক খাদ্য এবং পানীয় এর কারণে, যা আপনার দাঁতের এনামেলকে (enamel) ক্ষয় করে। সবচেয়ে বেশি ক্যাভিটিস সৃষ্টির জন্য দায়ী ক্রেকার্স (crackers) এবং রুটি, ক্যান্ডি নয়। যখন আপনি চিনিযুক্ত কিছু খেয়ে থাকেন, তখন প্রাকৃতিকভাবে আপনার মুখে থাকা ব্যাকটেরিয়া ভালোমতোই চিনিকে খেয়ে ফেলে। আর এসিড হচ্ছে ব্যাকটেরিয়ার অব্যবহৃত পদার্থ। তাই যখন তারা যেকোনো খাবার পায়, তারা এসিড নিঃসৃত করে। এ এসিড ডিক্যালসিফাইস (decalcifies) এর মাধ্যমে আপনার দাঁতের এনামেলের গঠনকে ক্ষতি করে এবং ক্যাভিটিস সৃষ্টি হয়।
- মিথ-০৫ঃ চিনির চেয়ে কৃত্রিম সুইটনার (sweeteners) ভালো
যদিও স্টেভিয়া (Stevia), ট্রুইভিয়া( Truvia) এবং অ্যাস্পার্টামের (aspartame) মতো কৃত্রিম সুইটনার যা ডায়েট সোডাতে পাওয়া যায়, তাদের থেকে চিনির তুলনায় কম ক্যালোরি পাওয়া যায়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, ডায়েট সোডা যারা পান করে না তাদের চেয়ে পানকারীদের স্থূলতা দ্বিগুণ বেশি দেখা যায়।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, একটি কৃত্রিম সুইটনার- স্যাকারিন, যা কোকেনের (cocaine) চেয়ে বেশি আসক্তিযুক্ত (addictive)। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ডায়েট সোডা পানকারীরা ৬৭% বেশি ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ডায়েটহীন সোডা পানকারীদের চেয়ে।
অতএব কিছু কৃত্রিম সুইটনারও চিনির মতই আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- মিথ-০৬ঃ আপনার স্বাস্থ্যের সকল সমস্যার মূল চিনি
সত্য হলো-চিনি আপনার স্বাস্থ্যের তেমন কোন ক্ষতি করে না। শুধু স্থূলতা এবং হার্টের রোগের জন্য কিছুটা দায়ী।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, স্থূলতার জন্য মিষ্টি খাবার ভুমিকা রাখে। তবে আপনি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারায় চলতে চেষ্টা করলে চিনিকে স্থূলতার জন্য একমাত্র দায়ী হিসেবে ধরতে পারেন না। চিনিযুক্ত খাবার থেকে অনেক ক্যালরি পাওয়া যায়। আপনি অনেক বেশি ক্যালরি গ্রহণ করলে, তা মিষ্টি খাবার থেকে হোক বা অন্য কোন উপায়ে, আপনার ওজন বাড়বে এটাই তো স্বাভাবিক।
- মিথ-০৭ঃ চিনি হার্ড ড্রাগের এর মতো আসক্তি (addictive)
চিনি গেটওয়ে ড্রাগের মতো কাজ করে, এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ নেই যে, চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া একটি আসক্তি। তবে চিনির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে যা আনন্দ সৃষ্টি করতে পারে। তাই চিনিযুক্ত খাবারের প্রতি লোভ থাকে, কিন্তু তা আসক্তির মতো কাজ করে না।
- মিথ-০৮ঃ ডায়েটিং (dieting) করলে ফল এড়িয়ে চলতে হবে
ফল অনেক সুস্বাদু হয়, এতে গ্লুকোজ থাকে বলে মিষ্টি হয়। আর তাই অনেকে মনে করে, যারা নিয়ন্ত্রিত ওজন রাখতে চায়, তাদের ফল খাওয়া এড়াতে হবে- ধারণাটি ভুল। বরং ফলে ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবারের মতো অনেক স্বাস্থ্যকর উপাদান থাকে। তাই গ্লুকোজ গ্রহণের পরিমাণ কমাতে আমাদের ডায়েট থেকে ফল বাদ দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত।
- মিথ-০৯ঃ চিনি ক্যান্সারের কারণ
ক্যান্সারের কোষগুলো দ্রুত বিভাজিত হয় অর্থাৎ তাদের এতে অনেক শক্তি প্রয়োজন হয় যা চিনি সরবরাহ করতে পারে। এটাই মূল কারণ অনেকের মাঝে ভুল ধারণাটি সৃষ্টি হওয়ার।
যাইহোক, সব কোষেরই শক্তি প্রয়োজন এবং ক্যান্সার কোষের বেঁচে থাকার জন্য গ্লুকোজ ছাড়া আরও অনেক উপাদান যেমন অ্যামিনো এসিড, ফ্যাট ইত্যাদি প্রয়োজন। তাই এখানে চিনিকে একা দায়ী করা যায় না।
এমন কোন প্রমাণ নেই যে, চিনিবিহীন ডায়েট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তবে ডায়াবেটিস এর সাথে মিলিয়ে এমনটা বলা যায়-বেশি পরিমাণ মিষ্টি জাতীয় খাওয়ার সাথে ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। আর অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ানোর সাথে সংযুক্ত। তাই যদিও এটি সরাসরি ক্যান্সারের কারণ নয়, তবে কেউ যদি অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি গ্রহণ করে এবং এতে ওজন বাড়ে, তাহলে তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়বে।
- মিথ-১০ঃ আমাদের আহার থেকে চিনিকে পুরোপুরি বাদ দিতে হবে
যেহেতু বেশি পরিমাণে চিনি খাওয়া অতিরিক্ত ওজন এবং দীর্ঘমেয়াদী অনেক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।তাই বলে এই না যে, আপনি চিনি খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিবেন। আপনার এটাও মনে রাখতে হবে গ্লুকোজ আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন।
কৃত্রিম সুইটনারযুক্ত সোডা-যা গ্রহণে কিডনির ক্ষতি, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ আরও অনেক রোগ সৃষ্টি হয়। তাই ডায়েট থেকে সোডাকে বাদ দেওয়া কোন কঠিন বিষয় হবে না।
সবশেষে বলতে চাই, যদিও চিনি নিয়ে আমাদের অনেক ভুল ধারণা রয়েছে, তবে এটি সম্পর্কে কিছু বিষয় সত্য।
ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের সাথে চিনি খাওয়ার সরাসরি কোন সম্পর্ক না থাকতে পারে কিন্তু বেশি পরিমাণে মিষ্টি জাতীয় খাওয়াও স্বাস্থ্যকর নয়। তাই সংযম এবং নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাওয়াই উত্তম সমাধান।
তানজিনা সুলতানা শাহীন / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ inside.com, medicalnewstoday