আধুনিক বিজ্ঞানে কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স হলো বিজ্ঞানের এমন এক শাখা যেখানে পদার্থ, শক্তি, আলোর পারমাণবিক বা অতিপারমাণবিক স্তরের কণার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও কিভাবে তারা পরস্পরের সাথে যোগযোগ রক্ষা করে তা বর্ণনা করে। কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স এর হাত ধরে আসতে চলেছে কোয়ান্টাম ইন্টারনেট নামক এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
পদার্থের মৌলিক কণা যেমন: ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত কণাগুলোর বৈশিষ্ট্য ও চালচলন আমাদের সাধারণ বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলে না, সেজন্য কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স এর প্রয়োজন।
প্রচলিত বিজ্ঞান দ্বারা প্রকৃতির যে-সব ঘটনা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ সেসব ঘটনা কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স দ্বারা অতি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। অনেকসময় এমন অনেক ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় যা ক্লাসিক্যাল বিজ্ঞানে কখনো সম্ভব না। যেমন: অণু পরমাণুর মডেল বিশ্লেষণ করা, অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও কমানো, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করা ইত্যাদি।
কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স এর বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে যে কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি হয় সেটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার। সাধারণ কম্পিউটার এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার পুরোপুরি ভিন্ন জিনিস। সাধারণ কম্পিউটার যেখানে বিট নিয়ে কাজ করে, সেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম বিট বা কিউ বিট নিয়ে কাজ করে।
বিট শুধু দুইটা অবস্থায় থাকতে পারে; শূন্য বা এক অথবা হ্যাঁ বা না। অন্যদিকে কিউ বিট শূন্য ও এক এর মাঝখানে যেকোনো অবস্থায় থাকতে পারে। বিটের চেয়ে কিউ বিটের ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। যেখানে n সংখ্যক বিট একই সময়ে n সংখ্যক তথ্য ধারণ করতে পারে, সেখানে n সংখ্যক কিউ বিট একই সময়ে 2^n সংখ্যক তথ্য ধারণ করতে পারে। সর্বশেষ তথ্যমতে আইবিএম প্রায় ১০০০ কিউ বিট বিশিষ্ট কোয়ান্টাম চিপ Condor Chip প্রকাশ করেছে।
যতই শক্তিশালী কম্পিউটার আসুক না কেন, একটি সিস্টেম থেকে অন্য সিস্টেমে তথ্য আদান প্রদান করা না গেলে উন্নত প্রযুক্তি থেকে ফল ভোগ করা কঠিন। বর্তমানে ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অন্যতম একটি অংশ। নেটওয়ার্কিং ছাড়া আমরা আমাদের ডিভাইসগুলোর অস্তিত্ব কল্পনাও করতে পারি না। তেমনিভাবে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন যাবৎ চেষ্টা করছে কোয়ান্টাম সিস্টেমের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বা কোয়ান্টাম ইন্টারনেট তৈরি করতে।
সম্প্রতি ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জার্মানির স্টুটগার্ট ও উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণায় বিশ্বে প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের বাস্তব রূপ দেখা গেছে। যেখানে দুইটা কোয়ান্টাম মেশিন পরস্পর সংযুক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে সংরক্ষিত তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। Science Advance নামক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে আরো জানা যায়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে টেলিযোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত অপটিক্যাল ফাইবার সিস্টেমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যও তারা শনাক্ত করতে পেরেছে।
প্রচলিত ইন্টারনেট সিস্টেমে দূরবর্তী স্থানে তথ্য স্থানান্তরের সময় তথ্যের শক্তি কমে যায়। এতে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা এড়াতে নেটওয়ার্ক সিস্টেমকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে রিপিটার ব্যবহার করা হয়।
রিপিটার নিম্ন শক্তির সিগন্যাল গ্রহণ করে সেটাকে পুনরায় শক্তি বৃদ্ধি করে প্রেরণ করে। কোয়ান্টাম তথ্যগুলোর আদান প্রদানের সময় শক্তির ক্ষয় হতে পারে। কিন্তু প্রচলিত রিপিটারের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব না। কারণ এসব রিপিটার কোয়ান্টাম তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ করতে সক্ষম না। রিপিটার কিউ বিট নিয়ে কাজ করতে পারে না।
এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে কোয়ান্টাম তথ্য বহন করতে পারে এমন কণার প্রয়োজন। আলোর ক্ষুদ্রতম একক কণা ফোটনই একমাত্র যা কোয়ান্টাম তথ্য সংরক্ষণ ও বহন করতে পারে এবং কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স এর বৈশিষ্ট্য গুলো ধারণ করতে পারে। যেমন: সুপার পজিশন, এন্টেনগেলমেন্ট ইত্যাদি। এমন ফোটন নির্গমন করার সর্বোত্তম বস্তু হল সেমিকন্ডাকটর কোয়ান্টাম ডট; পদার্থের ক্ষুদ্রতম সম্ভার যা অনন্য কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ আলো নির্গত করতে পারে।
এন্টেনগেল অবস্থায় থাকা দুইটা ফোটন কণা নিজেদের বৈশিষ্ট্য গুলো এমনভাবে বিন্যস্ত করে যে, একটিকে ছাড়া অন্যটির বৈশিষ্ট্য বুঝা যায় না। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তৈরি করতে এন্টেনগেল ফোটন দরকার।
ফোটনের মধ্যে এন্টেনগেলমেণ্ট করা ও কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্য দুইটা যন্ত্রের প্রয়োজন; একটি এন্টেনগেল ফোটন তৈরি করে, অন্যটি ফোটন গুলো সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তীতে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে। ঠিক তখনই সামনে আসে কোয়ান্টাম মেমোরির কথা। একইসাথে দুই যন্ত্রের মধ্যে কার্যকরভাবে যোগাযোগ রক্ষা করাটাও একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
ফোটন আলোর বেগে চলে এবং নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে, যা দৃশ্যমান আলোতে বিভিন্ন রং তৈরি করে। আবার ফোটন তৈরি ও সংরক্ষণের যন্ত্রগুলো বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সাথে কাজ করে, যা যন্ত্রদ্বয়ের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
এই প্রতিবন্ধকতা এড়ানোর জন্য গবেষকদল কোয়ান্টাম ডট তৈরি করে। এটি ১৫২৯.৩ ন্যানো মিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ফোটন নির্গত করে; যেই ব্যান্ডটি আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত ইন্টারনেট সিস্টেমেও ব্যবহার করা হয়। নির্গত ফোটনগুলো একটি মেমোরি সিস্টেমের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে রুবিডিয়াম পরমাণু মেঘ ব্যবহার করা হয়। একটি লেজার মেমোরির পালস নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে এটি ফোটনের কোয়ান্টাম অবস্থা সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজন অনুসারে পুনরুদ্ধার করতে পারে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এর অধ্যাপক, ড. সারাহ্ টমাস জানান,
“দুইটি যন্ত্রের মধ্যে ইন্টারফেসিং করতে পারা কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক এর অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং আমরা সত্যিই উচ্ছ্বাসিত যে আমরা প্রথম দল হিসেবে এটি সম্ভব করে দেখাতে পেরেছি।”
যাইহোক, এখনো কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক এর উন্নতি করার অনেক ধাপ রয়েছে। মেমোরির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সংরক্ষণের সময় বাড়ানো, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সহজ করা ইত্যাদি। এছাড়াও এই সিস্টেমের ব্যবহার বৃদ্ধি করার জন্য চিপ ভিত্তিক মেমোরি তৈরি করা জরুরি, যেখানে অনেক গুলো কোয়ান্টাম ডট ও কোয়ান্টাম মেমোরি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে।
এমন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, আগামীর বিশ্বে এই প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে। নিরাপদ যোগাযোগ, ডিস্ট্রিবিউটেড কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, উন্নত পরমাণুবিদ্যা, বৃহৎ পরিসরে কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের ব্যবহার ইত্যাদি ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
মোহাম্মদ রিফাতুল ইসলাম মারুফ / নিজস্ব প্রতিবেদক
সোর্স: সাইটেকডেইলি, লাইভসায়েন্স, সায়েন্স ডেইলি