প্রতিনিয়ত আসা নতুন প্রযুক্তি যেমন মানুষ কে দিয়েছে আয়েশি জীবন তেমনি তৈরি করেছে অনেক নতুন সমস্যা। সমস্যার বেশিরভাগই পরিবেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষতির কারণ। বর্তমান সময়ে এই পৃথিবী অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড যার মূলে রয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব পৃথিবীতে বসবাসরত প্রতিটি জীবের উপর পড়ছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রতিনিয়ত হয়ে উঠছে হুমকির কারণ।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ হলো গ্রীন হাউজ গ্যাস এর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি। উৎপন্ন এসব গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা উৎপন্ন হতে দেখা যায় তা হলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড। শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে যানবাহন সব ক্ষেত্রেই কার্বন ডাই অক্সাইডের অতিরিক্ত নির্গমন পরিবেশকে একরকম বিষাক্তই করে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত এই কার্বন ডাই অক্সাইডের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করেই যাচ্ছেন।
বর্তমান সময়ে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের কিছু প্রযুক্তি সামনে এসেছে। পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ এর এই প্রযুক্তিতে নতুনত্ব নিয়ে এসেছেন ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। তারা দেখিয়েছেন কিভাবে সহজে এবং স্বল্পমূল্যে ন্যানো-মেটেরিয়াল টেকনোলজির মাধ্যমে শিল্প এলাকা থেকে নির্গমন হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করা সম্ভব।
MOF বা metal organic framework হলো এমন এক ন্যানো-মেটেরিয়াল প্রযুক্তি যা পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের হার কমাতে ব্যবহার করা হয়। MFO এর বিশেষ ধরনের গঠন তথা জ্যামিতিক আকারের কারণে এটি অন্যান্য গ্যাস বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে নিজের মধ্যে আটকে নেয়। MFO এর মধ্যে থাকা ধাতব আয়ন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে একটি রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। একটি দুর্বল রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে MFO এর পৃষ্ঠের সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অণু লেগে যায়।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের প্রথাগত পদ্ধতিতে অনেক শক্তির অপচয় হয়। এতটাই এনার্জি কনজিউমিং হয় যে মাত্র ৩৫ শতাংশ আউটপুট পাওয়া যায়। অন্যদিকে MFO অনেকটা সাশ্রয়ী। MFO শুধুমাত্র রাসায়নিকভাবেই নয় বরং বিশেষ রকমের গঠন প্রণালীর কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অণু শোষণের ক্ষেত্রে বেশ সফলতা দেখিয়েছে।
রসায়নের সহকারী অধ্যাপক কিরিয়াকোয়াস স্টাইলিয়ানো এর মতে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড ইমিশন নেট-জিরো তে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য। MFO বা metal organic framework এর কাঠামোগত বহুমুখী তার কারণে কার্বন ক্যাপচারের জন্য নিজেদের উপযোগিতা ইতোমধ্যে প্রদর্শন করেছে। তবে MFO সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশগতভাবেও ব্যয়বহুল। কেননা এতে ব্যবহৃত হয় ভারী ধাতু লবণ ও বিষাক্ত দ্রাবক।
পাশাপাশি তিনি আরো বলেন MFO আর্দ্র বা ভেজা অবস্থায় কার্বন শ্বসনের ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর নয়। যদিও MFO টেকনোলজি ব্যবহৃত ফ্লু গ্যাসগুলোকে শুকনো করে ব্যবহার করা যেতে পারে কিন্তু তা অনেকাংশেই প্রযুক্তিটি কে অব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারে।
সেই MFO বা metal organic framework প্রযুক্তিতেই নতুনত্ব এনেছেন ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা। কিরিয়াকোয়াস স্টাইলিয়ানো বলেছেন,
“MFO প্রযুক্তিতে উচ্চ খরচ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণে দুর্বলতা, আর্দ্র অবস্থায় অক্ষমতার মতো সমস্যাগুলো সমাধানে মোকাবেলার জন্য আমরা কাজ করেছি।”
MFO হলো একটি কেলাস জাতীয় পদার্থ যা ছিদ্রযুক্ত। এটি লিগ্যান্ড নামে পরিচিত জৈব “লিঙ্কার” অণু দ্বারা বেষ্টিত এবং ধনাত্মক চার্জযুক্ত ধাতব আয়ন দ্বারা গঠিত। ধাতব আয়নগুলি নোড তৈরি করে যা লিঙ্কারদের বাহুগুলিকে আবদ্ধ করে একটি গঠন তৈরি করে যা দেখতে খাঁচার মতো। কাঠামোটিতে ন্যানোসাইজড ছিদ্র রয়েছে যা স্পঞ্জের মতো গ্যাস শোষণ করে।
গবেষকরা এই MFO তে এলুমিনিয়াম এবং সহজলভ্য লিগেন্ড বেনজিন-1,2,4,5- টেট্রাকারবক্সিলিক অ্যাসিড ব্যবহার করেছেন। ফলে এর কার্যকরীতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন H4BTEC (বেনজিন-1,2,4,5- টেট্রাকারবক্সিলক এসিড) ধাতব আয়নগুলোর সাথে যুক্ত হয় তখন একটি বিশেষ ছিদ্র যুক্ত MFO কাঠামোর গঠন করে। এই ছিদ্র MFO কে বায়ু প্রবাহ থেকে বেছে বেছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করার সক্ষমতা দেয়। যা MFO প্রযুক্তি কে করবে আরো শক্তিশালী। ফলে প্রক্রিয়াটি হবে সাশ্রয়ী এবং কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি আর্দ্র অবস্থায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের কোন সমস্যাই আর থাকবেনা।
প্যাসিফিক নর্থ ওয়েস্ট ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গাবেষকরাও এই গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন।
ভবিষ্যতে শিল্পে আরও উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তি আরো বেশি কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়। সেই সাথে পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যা মোকাবেলায় এ পর্যন্ত ব্যাপক অবদান রাখবে এই প্রত্যাশা বিজ্ঞানীদের।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ফিজিক্স.অর্গ, টুডে.অরিগনস্টেট.এডু, প্রোমিথেনপার্টিকেল.কো.ইউকে, সেল.কম