“আলো আমার, আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার আলো হৃদয় হরা”
আলো ঝলমলে এই পৃথিবীতে এক মুহূর্তের অন্ধকার যেন দম কেড়ে নেয়। পৃথিবীজুড়ে কৃত্রিম আলোর সাগরে ভাসতে ভাসতে কখনও ভেবেছেন সত্যিকারের অন্ধকার কেমন? কিংবা সত্যিকারের রাতের আকাশটাই বা দেখতে কেমন? যদি ভেবে থাকেন তবে আপনি সত্যিকারের অন্ধকার কিংবা অন্ধকার আকাশ দেখার সুযোগ ব্যস্ত এই শহরে বসে পাবেন না। সেই সুযোগ অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে আলোক দূষণ। হ্যাঁ আলোক দূষণ; শব্দদূষণ,বায়ুদূষণ, পানিদূষণের মতো আলোকদূষণও এক নীরব ঘাতক।
১৯৯৪ সালে আমেরিকার লস এঞ্জেলস শহরে শেষরাতে ভূমিকম্পের ফলে পুরো শহর যখন ব্ল্যাকআউটে চলে যায় তখন শহরবাসী রাতের আকাশে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির শত শত নক্ষত্র দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। কেননা দীর্ঘদিন আলোক-দূষণে নিমজ্জিত শহরবাসী প্রায় ভুলেই গিয়েছিল রাতের আকাশ আসলে দেখতে কেমন!
আলোক দূষণ হলো অবাঞ্ছিত, অনুপযুক্ত বা অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি। রাতের বেলায় অতিরিক্ত কৃত্রিম আলো যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলছে তাকেই আলোক দূষণ বলা হয়। ২০১৬ সালের ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অফ আর্টিফিশিয়াল নাইট’-এর স্কাই ব্রাইটনেসের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ মানুষ আলোক দূষিত আকাশের নিচে বসবাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ৯৯ শতাংশ মানুষ প্রাকৃতিক রাত উপভোগ করতে পারেন না।
আলোক দূষণ কী?
কৃত্রিম উৎস (যেমন ঘর, অফিস এ ব্যবহৃত লাইট বাল্ব, স্ট্রিটল্যাম্প, ইলেকট্রনিক বিলবোর্ড, বা গাড়ির হেডলাইট) থেকে হওয়া আলোক দূষণের ধরণের উপর ভিত্তি করে একে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে প্রধান ৪টি ভাগ: Glare, Light-trespass, Clutter এবং Sky glow Glare হলো অতিরিক্ত আলোতে দেখতে সমস্যা হওয়া যেমন গাড়ি চালানোর সময় হাইবিম হেডলাইট বা সড়ক বাতির আলো।
Light Trespass হলো যেখানে আলোর প্রয়োজন নেই সেখানে আলো থাকা। Clutter হলো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একসাথে অনেক আলো যেমন শপিংমল কিংবা ব্যস্ত কোনো চৌরাস্তা। আর সব শেষে সবচেয়ে বড় দূষণ হলো Sky glow যার ফলে পুরো জনবসতি বা শহর থেকে আসা আলো আকাশ কে উজ্জ্বল করে তোলে। এই উজ্জ্বল আকাশ প্রায় ১৫০ মাইল দূর দেখেও দেখা যেতে পারে।
মানুষের স্বাস্থ্যে প্রভাব
অতিরিক্ত আলো মানুষের স্বাস্থ্যে প্রতিকূল প্রভাব (Adverse health effects) ফেলে। যেমন মাথাব্যথার প্রকোপ বৃদ্ধি, অবসাদগ্রস্থতা বেড়ে যাওয়া, যৌন ক্রিয়া হ্রাস পাওয়া এবং বাড়ন্ত উদ্বেগ। গবেষণায় দেখা যায় যে মানুষ যখন রাতে বাহিরে বের হয়ে কৃত্রিম আলোর সংস্পর্শে আসে তখন রক্তরসে মেলাটোনিন হরমোনের পরিমাণ কমে যায় যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। মেলাটোনিনের হ্রাস এস্ট্রোজেন হরমোন কমিয়ে দেয় যার পরিণতি হতে পারে ব্রেস্ট ক্যান্সার।
শহুরে স্কাইগ্লোর (urban sky glow) নিম্ন ঘনত্বের আলোও মেলাটোনিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মেলাটোনিন হ্রাস আমাদের অভ্যন্তরীণ ছন্দ ডিসিনক্রোনাইজ করে স্লিপ ডিজঅর্ডার এর সৃষ্টি করে, যা আমাদের উপযুক্ত সময়ে ঘুমানো এবং জেগে ওঠার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়।
আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম একটা প্যাটার্ন অনুযায়ী চলে। একে সার্কাডিয়ান ছন্দ বা জৈবিক ঘড়ি (Circadian Rhythm / Biological clock) বলে।
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সার্কাডিয়ান ছন্দ (Circadian rhythms) আমাদের দৈনন্দিন এবং সিজনাল আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে যেমন খাওয়া দাওয়া, হাইবারনেশন, প্রজনন ইত্যাদি। সার্কাডিয়ান ছন্দের ব্যাঘাত মানুষের ওজন বাড়ানো এবং আবেগি হওয়ার কারণ হতে পারে। Suprachiasmatic Nucleus (SCN) হাইপোথ্যালামাসের একটি অংশ যাকে সার্কাডিয়ান পেসমেকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটা আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সময়মতো সিগনাল পাঠায়।
কিন্তু অতিরিক্ত আর্টিফিশিয়াল আলো সার্কাডিয়ান ছন্দের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
এছাড়াও আমরা এখন বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করি যেগুলো নানান রঙের আলো নির্গমন করে। আমাদের স্মার্টফোন এবং ল্যাপটপ থেকে নীল আলো (Blue light) নির্গত হয়। এই আলোও আমাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি করে।
বন্যপ্রাণী ও গাছপালার উপর প্রভাব
আলো দূষণের এই ক্রমবর্ধমান সমস্যা যে শুধুমাত্র মানুষের ক্ষতি করছে এমনটি কিন্তু নয়। মানুষের পাশাপাশি বন্যপ্রাণী এমনকি গাছপালাও এই আলোক দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। দিনে-রাতে সমান আলো থাকার কারণে প্রতিবছর ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রানীর ঘুমের চক্র পরিবর্তন হচ্ছে, যার কারণে তারা বংশবিস্তারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। Florida Atlantic University’র দেয়া তথ্য অনুসারে অতিরিক্ত আলোর ফলে গাছের পত্ররন্ধ্র অধিক সময় ধরে খোলা থাকে যা গাছে বায়ু দূষণের প্রভাবকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাছাড়া কৃত্রিম আলো গাছের ফুল ফোটার সময় পরিবর্তন করছে ফলে গাছের ঠিকঠাক পরাগায়ন হচ্ছে না এবং বীজ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে কৃত্রিম আলোর সংস্পর্শে থাকার কারণে গাছের কান্ড ও ফলমূলের আকৃতিও বিকৃত হচ্ছে।
পাখিদের উপর প্রভাব
আলোক দূষণের ফলে পাখিদের স্লিপ সাইকেলে প্রভাব পরে। এর ফলে তাদের জীবন ধারণ যেমন হয়ে পরে কষ্টকর তেমনি তাদের প্রজননেও সমস্যা দেখা দেয়। রাতে অন্ধকারের অভাব তাদের দেহের কোষীয় এবং জিনগত ক্ষতিসাধন করে।
পাশাপাশি পরিযায়ী পাখিরা দিন ও রাতের তফাৎ ঠিকঠাক বুঝতে না পারার ফলে সঠিক ভাবে স্থানান্তরিত হতে পারে না। প্রতিবছর সিডনি অপেরা হাউসের উজ্জ্বল আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে অনেক পাখি মারা যায়। আর যেসব পাখি নিশাচর তাদের জন্য রাতের বেলা শিকার করা ও খাদ্য আহরণ করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়।
পোকামাকড়দের উপর প্রভাব
পোকামাকড় কিংবা কীটপতঙ্গের উপরও সরাসরি প্রভাব ফেলেছে আলোক দূষণ। ধারণা করা হয় প্রায় অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি কীটপতঙ্গ প্রজাতি কেবলই নিশাচর। অর্থাৎ, তারা প্রধানত রাতেই সক্রিয় থাকে। শিকার কিংবা খাদ্য সংগ্রহে তারা বাহিরে বিচরণ করে। কিন্তু অতিরিক্ত আলোক দুষণের ফলে তারা সচরাচর পথভ্রষ্ট হয় এবং এটি তাদের শিকারে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে এই দূষণে তাদের জীবন চক্রে সরাসরি মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।
The Guardian এ প্রকাশিত এক গবেষণার প্রতিবেদনে Damian Carrington তুলে ধরেন যে, Myflies এর মত কিছু প্রজাতি যারা মাত্র একদিন বেঁচে থাকে তারা পানির নিকটে গিয়ে বংশবিস্তারের জন্য আলোকে কাজে লাগায়। কিন্তু আলোক দূষণের ফলে তারা পথ হারায় এবং হ্রদ, স্রোত কিংবা জলাশয়ে বংশবিস্তার করতে গিয়ে স্থলভাগেই ডিম ছেড়ে দেয়। যার ফলে কেবল এক রাতেই আলোক দূষণ তাদের পুরো বংশ নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। পোকামাকড় গাড়ির হেডলাইটেও আকৃষ্ট হয়। ধারণা করা হয় প্রতি গ্রীষ্মে জার্মানির মহাসড়কে এ কারণে ১০০ বিলিয়নের বেশি পোকামাকড় তাদের প্রাণ হারায়। যার ফলে তাদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
সামুদ্রিক প্রাণীদের উপর প্রভাব
আলোক দূষণএর হাত থেকে রক্ষা পায়নি সামুদ্রিক প্রাণীরাও। Florida Atlantic University এর জীববিজ্ঞানী Dr. Michael Salmon এর গবেষণা অনুযায়ী, কৃত্রিম আলোতে বিভ্রান্ত হয়ে বাচ্চা কচ্ছপেরা সাগরের বদলে শহরের দিকে চলে আসে যা তাদের ক্লান্তি, পানিশূন্যতা এবং অন্যান্য প্রাণীর সহজ শিকারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শুধুমাত্র ফ্লোরিডাতেই এই কারণে বছরে লক্ষ লক্ষ সামুদ্রিক কচ্ছপ মারা যায়।
সামুদ্রিক জুপ্ল্যাংকটন রাতের বেলা উপরের স্তরে উঠে সামুদ্রিক এলগি খায়। কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতে তারা উপরে উঠে আসতে ব্যর্থ হয়। ফলে এলগির সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায় ও জলজ পরিবেশের ভারসাম্য হারায়। সামুদ্রিক কোরাল অমাবস্যা ও পূর্ণিমার উপর নির্ভর করে ডিম দেয়। কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতে তারা সঠিক সময়ে ডিম দিতে পারে না, ফলে বংশ বিস্তার ব্যাহত হয়। তাছাড়া বেশিরভাগ মাছই সাদা আলো এড়িয়ে চলে যা তাদের খাদ্য আহরণ ও স্থানান্তরে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ব্যাহত হওয়া
রাতভর কৃত্রিম আলোর প্রভাবে আকাশ উজ্জ্বল দেখায়। যার ফলে রাতের আকাশে এখন আর তারা দেখা যায় না। আলোকদূষণ নিয়ে কাজ করা সংস্থা Glove At Night গবেষণা অনুযায়ী প্রতিবছর রাতের আকাশে কৃত্রিম আলোর প্রভাব বছরপ্রতি ৯.৬% বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যে শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণাই ব্যাহত হচ্ছে তাই নয় বরং যেসব বন্য ও সামুদ্রিক প্রাণী তারার অবস্থান দেখে দিকনির্ণয় ও এলাকা পরিবর্তন করে তারাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
আলোক দূষণ রোধে পদক্ষেপ
International Dark Sky Association আলোক দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং তা রোধে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুসারে কিছু পদক্ষেপ আছে যা গ্রহণ করে আলোক দূষণ অনেকটা কমানো সম্ভব। যেমন LED ও CFL এর ব্যবহার কমানো এবং প্রয়োজনের তুলনায় কৃত্রিম আলো ব্যবহার না করা। নীল বা সাদা আলোর ব্যবহার কমিয়ে বিভিন্ন ব্যস্ত সড়ক কিংবা কনস্ট্রাকশন এরিয়ায় হলদে বা কমলা বর্ণের আলো ব্যবহার করা, সম্ভব হলে মোশন সেন্সর বা টাইমারের মাধ্যমে আলো নিয়ন্ত্রণ করা।
IDSA এর জরিপ অনুসারে আমেরিকায় আলোক দূষণের কারণে বছরে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যেরর শক্তি অপচয় হয় ও ২১ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাতের বেলায় বিভিন্ন অবকাঠামো মূলক কাজের কারণে প্রতিনিয়তই আলোক দূষণ বেড়ে চলেছে। তাই মানুষ, প্রাণীকুল এবং গাছপালার ক্ষতি সাধন রোধে আলোকদূষণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং তা কমিয়ে আনতে কাজ করার এখনই সময়।
তা না হলে হয়তো তারা ভরা আকাশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে শুধুমাত্র কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা আর উপন্যাসের উপমা হয়েই থাকবে।
সায়েন্স বী নিউজ টিম ৫.০ এর সকল সদস্য / যৌথ প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ ইকোওয়াচ.কম, বার্টলবাই.কম, বিবিসি.কম, এভরিথিং কানেক্ট.অর্গ, রিসার্চগেট.নেট