মহাকাশ যুগের পর যুগ ধরে আগ্রহ যুগিয়েছে লাখো মানুষকে। মহাকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছেন অনেকেই, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণও হয়তো হয়নি অনেকেরই। নভোচারী হওয়ার জন্য বা নভোচারী হতে চাইলে যে সংস্থার কথা প্রথমেই মাথায় আসে সেটি হচ্ছে নাসা। আনুষ্ঠানিকভাবে নাসা তাদের বিভিন্ন মিশনের অংশ হিসেবে মহাকাশে নভোচারীদের প্রেরণ করে থাকে। তবে এর জন্য প্রত্যেকটি নভোচারীকে কঠোর ট্রেনিং এবং বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। চলুন জেনে আসা যাক নাসার নভোচারী হতে চাইলে কি কি করতে হবে আপনাকে:
প্রথমত, আপনাকে আমেরিকার নাগরিক হতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বি-নাগরিকত্ব বিশিষ্ট নাগরিকদের আবেদনও গ্রহণ করা হয়। এরপর আসা যাক প্রতিযোগিতার কথায়। নাসা তাদের নভোচারী নিয়োগের জন্য যে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, সেই বিজ্ঞাপনের তথ্যানুসারে আপনাকে নাসার জন্য আবেদন করতে হবে। নাসা প্রতি চার বছর বা তারও কিছু পরে নতুন নভোচারী নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। ২০১৩ সালে ৬০০০ জন মানুষ মহাকাশচারী হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন; কিন্তু নাসা তাদের মধ্য থেকে মাত্র আট জনকে বাছাই করেছিল।
আবার যখন ২০১৭ সালে ১৮,৩০০ জন আবেদন করেছিল, তখন মাত্র ১২ জনকে বাছাই করা হয়েছিল। সুতরাং, বাছাই হওয়ার সুযোগ ১% এরও কম। যেহেতু নাসা খুব অল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে কাজ করে থাকে তাই নাসায় কাজ করতে চাইলে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড অবশ্যই বেশ শক্তিশালী হতে হবে। প্রাথমিক ভাবে নাসায় প্রশিক্ষণরত নভোচারীরা ২ বছর একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আওতায় থাকে এবং এদের মধ্য থেকে পুনরায় যাচাই করে হাতে গোনা কয়েকজনকে বাছাই করে {এই বাছাই পদ্ধতিকে “AsCans” (Astronaut candidates) বলা হয়} নাসা ট্রেনিংয়ে কতজন অংশ নিবে তা মূলত নির্দেশ করে আবেদন কতগুলো জমা পড়েছে তার উপর। প্রত্যেক AsCans কে মৌলিক কিছু বিষয় শেখানো হয়ে থাকে যেমনঃ
★ লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম
★ অরবিটাল মেকানিক্স
★ পে -লোড স্থাপন
★ পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ12
তাই আপনাকে অবশ্যই বিজ্ঞান বিভাগের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে অর্থাৎ আপনাকে বিজ্ঞানের ছাত্র হতে হবে। নাসা তাদেরই বেছে নেয় যারা গণিত এবং বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে অভিজ্ঞ এবং এক প্রকার বিশেষজ্ঞও বলা যেতে পারে। উল্লেখ্য, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ‘নভোচারী’ নামক কোনো বিশেষ বিষয় পড়ানো হয় না। তাই আবেদনকারীদের অবশ্যই একটি প্রাসঙ্গিক STEM ক্ষেত্রে স্নাতক ডিগ্রি এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। এই বিষয়গুলোর মধ্যেঃ- ইঞ্জিনিয়ারিং, জীববিজ্ঞান , শারীরিক বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান বা গণিত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । নাসা এমন মহাকাশচারীদেরও দলে নেয় যারা কমপক্ষে দুই বছর ডক্টরাল প্রোগ্রাম এ রয়েছেন, যাদের মেডিকেল ডক্টরাল ডিগ্রি আছে, অথবা যারা টেস্ট পাইলট স্কুল প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছেন।
সবমিলিয়ে, নভোচারীরা সাধারণত পোস্ট -সেকেন্ডারি স্কুলে অন্তত ছয় বছর কাটান – তবে যদি তাদের ডক্টরেট ডিগ্রি থাকে তাহলে এই সময়কাল আরও বাড়তে পারে। নভোচারীদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াও উক্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়াও তাদের একটি জেট বিমানে অন্তত ১,000 ঘন্টা পাইলট-ইন-কমান্ড হিসেবে সময় পার করতে পারার অভিজ্ঞতা আবশ্যক। নভোচারীদের “NASA long-duration flight astronaut physical” পাস করতে হয়। আপনার উচ্চতা যদি 5 ফুট 2 ইঞ্চি নিচে বা 6 ফুট 3 ইঞ্চির উপরে হয়ে থাকে তবে আপনি নির্বাচিত হবেন না। প্রার্থীদের 20/20 দৃষ্টিশক্তি থাকা প্রয়োজন, যদিও তারা পরিপূরক লেন্স ব্যবহার করতে পারবেন। বসে থাকা অবস্থায় তাদের রক্তচাপও কোনোমতেই 140/90 অতিক্রম করতে পারবে না।
যখন নাসায় চাকরির জন্য আবেদন করার কথা আসে, তখন নাসার নভোচারী অ্যান ম্যাকক্লেইন কিছু পরামর্শ দেন : “আপনার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে কাজ করুন। নিশ্চিত করুন যেন এটি সংক্ষিপ্ত এবং ত্রুটিমুক্ত হয়। নাসা চায় যেন তার মহাকাশচারীরা ক্ষুদ্র বিবরণগুলোতেও মনোযোগ দেয়, বিজ্ঞানীদের জন্য ক্ষুদ্র বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে দেখাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা।”
নভোচারী হওয়ার যাত্রাটা কিন্তু এতো সহজ নয়। এমনকি যদিও নাসা আপনাকে আবেদন অনুমোদন করে তারপরও আপনার পৃথিবীর থেকে বেরিয়ে যেতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
নাসায় আবেদন অনুমোদিত হলে প্রথমে আপনাকে দুই বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং শ্রেণীকক্ষে অধ্যয়ন উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মহাকাশচারী প্রশিক্ষণার্থীরা রাশিয়ান অধ্যয়ন করে যাতে তারা রাশিয়ান মিশন কন্ট্রোল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় এবং মহাকাশে বসে স্পেসশিপ ও মহাকাশ স্টেশন সংক্রান্ত বিজ্ঞান উভয় বিষয় সম্পর্কেই জানতে পারে।
মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই নানা শারীরিক পরীক্ষা পাস করতে হবে, যেমনঃ- ফ্লাইট স্যুট পরহিত অবস্থায় তাদের স্কুবা ডাইভিং এবং পুলের মধ্যে তিনটি ল্যাপ সাঁতার কাটতে সক্ষম হবার সার্টিফিকেট অর্জন করতে হবে । তাদের অবশ্যই মিলিটারিদের মতো ট্রেনিং নিয়ে জমি এবং জলে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ নিতে হবে, যা জরুরি অবস্থার জন্য অপরিহার্য।
পরিশেষে, প্রশিক্ষণার্থীদের অবশ্যই স্টিম্যুলেশন অনুশীলন করতে হবে, যা তাদের উচ্চ এবং নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় চাপে অভ্যস্ত হতে সহয়তা করবে।
ছয় বছরের স্কুলে পড়া এবং দুই বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার উপরে, নভোচারীদের অবশ্যই দুই বছরের বাধ্যতামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হবে। এই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে প্রায় এক দশক পর্যন্ত সময় ব্যয় হয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের পরেও নভোচারীদের তাদের প্রথম মহাকাশ অভিযানে যাওয়ার আগে কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হতে পারে। পৃথিবী ছাড়ার আগে, নভোচারীদের অবশ্যই এডভান্স মিশন ট্রেইনিং শেষ করানো হয় , যা তাদের মহাকাশ অনুসন্ধানকে আরও পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করে।
এখন আপনিও কী নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন? কিংবা মহাকাশে যেতে চান? কমেন্টে জানান।
লেখকঃ Fariha Karim | Science Bee