রক্তচাপ নিয়ে মোটামুটি সবাই-ই কমবেশি জানি। রক্তচাপ হলো আপনার দেহে প্রবাহমান রক্ত রক্তবাহিকার প্রাচীরে যে পার্শ্বীয় চাপ দেয়, তা। আমরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত উচ্চরক্তচাপ ও নিম্নরক্তচাপের সাথে। উচ্চরক্তচাপকে “নীরব ঘাতক” বলা হয় কারণ এটির কোনো উপসর্গ নেই এবং এটি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সঠিক চিকিৎসা না করালে।
আপনার রক্তচাপ জানার এবং হার্টের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার একমাত্র পদ্ধতি হলো সঠিক পরীক্ষা এবং ঘন ঘন পরিমাপ করা। এটি পরিমাপ করা হয় দুইটি সূচকের সাহায্যেঃ
১। সিস্টোলিক চাপ (উপরের সংখ্যা): আপনার হার্ট সংকুচিত থাকা অবস্থায় প্রবাহমান রক্ত, ধমনীর প্রাচীরে যে উচ্চচাপ দেয়।
২। ডায়াস্টোলিক চাপ (নিচের সংখ্যা): আপনার হার্ট প্রসারিত থাকা অবস্থায় প্রবাহমান রক্ত, ধমনীর প্রাচীরে যে নিম্নচাপ দেয়।
রক্তচাপ পরিমাপ করা হয় পারদ এর মিলিমিটার হিসেবে (mm Hg)। সাধারনত উচ্চরক্তচাপ হলেই তাকে সমস্যা ধরা হয়, মেডিক্যালি যাকে হাইপারটেনশন বলে, ডাক্তাররা রক্তচাপ নির্ণয়কে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেনঃ
স্বাভাবিক রক্তচাপঃ স্বাভাবিক রক্তচাপ ধরা হয় যদি
- সিস্টোলঃ ১২০ mm Hg এর মধ্যে হয়,
- ডায়াস্টোলঃ ৮০ mm Hg এর মধ্যে হয়
যদি আপনার রক্তচাপ এই সংখ্যার আশেপাশে হয়, তাহলে আপনার হার্ট সুস্থ বলে বিবেচিত হবে। আবার, অনেকসময় আপনার স্বাভাবিক রক্তচাপ থাকলেও, কিছু কিছু অভ্যাস সময়ের সাথে আপনার হাইপারটেনশনের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলে।
এগুলো হলো-
- সিগারেট খাওয়া,
- শারীরিক ব্যায়াম কম করা,
- শরীরে চর্বি জমা,
- বেশি লবণ খাওয়া,
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল খাওয়া,
- পরিবারে উচ্চ রক্ত চাপের পূর্ব ইতিহাস থাকা,
নিম্ন রক্তচাপঃ
রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই কম হয়। নিন্ম রক্তচাপ ধরা হয় যদিঃ
- সিস্টোলিকঃ ৯০ mm Hg এর কম,
- ডায়াস্টোলিকঃ ৬০ mm Hg এর কম
নিম্ন রক্তচাপ সবসময় উদ্বেগের কারণ হয় না; আসলে, এটি বেশির ভাগসময়ই ক্ষতিকর নয় এবং এমনকি ভাল স্বাস্থ্যের ইঙ্গিত দিতে পারে। তবুও, নিম্ন রক্তচাপে যখন নিচের উপসর্গগুলো দেখা দেয়, তখন আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিতঃ
- দাঁড়ালে ওজনহীন মনে হওয়া,
- মাথাঘোরা ,
- দ্রুত, অগভীর নিশ্বাস
- অযথা তৃষ্ণার্ত হওয়া,
- বমি বমি ভাব,
এই লক্ষণগুলো পরিস্থিতি ও চিকিৎসার জন্যও দেখা দিতে পারে। নিম্ন রক্তচাপ সাধারণত পার্কিনসন রোগ, হরমোনের পরিবর্তন এবং গর্ভাবস্থায় ঘটে থাকে।
আরও পড়ুনঃ ১। একবেলা উচ্চ ফ্যাটজাতীয় খাবার হতে পারে মনোযোগ হ্রাসের কারণ ২। বোবাই ভূত বা স্লিপ প্যারালাইসিস কী? এর থেকে মুক্তির উপায় ৩। বিশ্ব ব্লাড ক্যান্সার দিবস; জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের করণীয় |
উত্থিত রক্তচাপঃ
উত্থিত রক্তচাপ হয় যদি-
- সিস্টোলিকঃ ১২০-১২৯ mm Hg এর মতো,
- ডায়াস্টোলিকঃ ৮০ mm Hg এর নিচে
এটি উচ্চ রক্তচাপের প্রথম লক্ষণ। এই সময় জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলি যেন কার্যকরভাবে রক্তচাপকে কমাতে পারে এমন ভাবেই আনা উচিত, যেমন-
- ভালো ওজন বজায় রাখা,
- বেশি ব্যায়াম করা,
- সোডিয়াম জাতীয় খাদ্য কম গ্রহন করা,
- খাদ্যভাস নিয়ন্ত্রণ এ রাখা,
- অ্যালকোহল না খাওয়া,
- ধুমপান বন্ধ করা,
- মানসিকভাবে সুস্থ থাকা
হাইপারটেনশনঃ প্রথম স্টেজ
হাইপারটেনশন হয় যখন,
- সিস্টোলিকঃ ১৩০-১৩৯mm Hg এর মধ্যে হয়,
- ডায়াস্টোলিকঃ ৮০-৮৯ mm Hg এর মধ্যে হয়
এই স্তরে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য সাধারণত ওষুধকে প্রয়োজনীয় বিবেচনা করা হয় না। বরং এর পরিবর্তে রক্তচাপ কমানোর জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার প্রতিশ্রুতি নেওয়া উচিত।
হাইপারটেনশনঃ দ্বিতীয় স্টেজ
হাইপারটেনশনের ঝুঁকি আরও গুরুতর হয় যখন-
- সিস্টোলিকঃ ১৪০ mm Hg এর বেশি হয়,
- ডায়াস্টোলিকঃ ৯০ mm Hg এর বেশি হয়
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে জীবনযাপনের পরিবর্তনগুলো এই পর্যায়ে আনা খুবই প্রয়োজনীয়। যদি চিকিৎসা না করানো হয়, উচ্চ রক্তচাপ যেসব শারীরিক ক্ষতি করবে-
- হার্ট এটাক,
- হার্ট ফেইলিওর,
- স্ট্রোক,
- দৃষ্টিশক্তি নষ্ট,
- যৌন অক্ষমতা,
- কিডনীর সমস্যা বা কিডনী অক্ষমতা,
মারাত্মক উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যাঃ
মারাত্মক উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হবে যদি-
- সিস্টোলিকঃ ১৮০ mm Hg এর বেশি হলে,
- ডায়াস্টোলিকঃ ১২০ mm Hg এর বেশি হলে
এই পর্যায়টি অত্যন্ত ভয়ংকর হতে পারে এবং অনেক সময় জরুরি চিকিৎসার দরকার হয়, যদি এটির সাথে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায় তবে তা আরও বিপদজনকঃ
- নিশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া,
- মাথা ব্যাথা,
- নাক দিয়ে রক্ত পরা,
- অতিরিক্ত উদ্বেগ,
- পিঠে ব্যাথা,
- অসাড় অবস্থা,
- দৃষ্টি শক্তির পরিবর্তন
হাইপারটেনশন সমস্যা অঙ্গহানীর কারণ হতে পারে, এবং স্ট্রোক করার অনেক ঝুঁকি থাকে, হার্ট এটাক এবং অন্যান্য জীবনহানীকর পরিনতিও হতে পারে।
যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় তবে অতি জরুরী ভাবে ইমারজেন্সি নাম্বারে কল করা উচিত।
আরও পড়ুনঃ ১। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ৫ টি প্রাকৃতিক পদ্ধতি ২। ঘুম ও ওজন বৃদ্ধির মধ্যে যােগসূত্র: কম ঘুম ওজন বৃদ্ধির কারণ |
কত সময় পর পর রক্তচাপ নির্ণয় করা উচিতঃ
যদি আপনার স্বাভাবিক রক্তচাপ থাকে, এবং হাইপারটেনশনের ঝুঁকিতে কম থাকেন, তবে আপনার প্রতি বছরে একবার নিয়মিতভাবে রক্তচাপ পরীক্ষা করালেই হবে!
আর, যদি আপনার হাইপারটেনশনের ঝুঁকি থাকে, তবে আপনার ঘরে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করা প্রয়োজন।
আপনি যদি উচ্চরক্তচাপের ২য় স্টেজে ঝুঁকিতে থাকেন বা মারাত্মক উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগেন তবে, রক্তচাপ মাঝে এক মিনিট বিরতি নিয়ে সকালে এবং সন্ধ্যায় দুবার করে পরিমাপ করা উচিত। প্রতিবার রক্তচাপ পরিমাপের আগে পাঁচ মিনিট শান্ত ভাবে বসে থাকবেন। আপনি ব্যায়াম করে, বাহিরে ঘুরে আসার পর বা পাঁচ মিনিট অপেক্ষা না করে, যদি রক্তচাপ পরিমাপ করেন, তবে সেই রক্তচাপ নির্ণয়ে সঠিক ফলাফল আসবে না।
রওনক শাহরিয়ার/ নিজস্ব প্রতিবেদক