TRD (Treatment resistant depression) এরকম এক ধরনের ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বা হতাশার ব্যাধি। সাধারণত মেডিক্যালি চিকিৎসা নিয়ে এন্টিডিপ্রেস্যান্ট ঔষধ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেয়ার পরও যখন কারো মাঝে হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্মণ পরিলক্ষিত হয়না, তখন একে TRD হিসেবে গণ্য করা হয়।
ডিপ্রেশন শব্দটির সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। প্রত্যেকটি মানুষই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে এসে জীবনের কত শত বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হতে কখন যে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায় টেরও পায় না। যদিও আমরা সাধারণত খুব একটা পাত্তা দিই না তবে মানসিক অসুস্থতার প্রভাব আমাদের খাওয়া, ঘুম সহ যাবতীয় দৈনন্দিন কাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে শুরু করলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দুটোর সমন্বয় অতি গুরুত্বপূর্ণ। ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার গুলো সম্পূর্ণই একজন ব্যক্তির মেন্টাল স্টেট তথা মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ।
মানব মস্তিষ্ক বেশ অদ্ভুত একটি যন্ত্র। মানুষ ভেদে তার ব্যক্তিত্ব, মানসিক অবস্থা ,আশপাশের পরিবেশ, এসবের উপর ভিত্তি করে মস্তিষ্ক বাইরে থেকে আগত বিভিন্ন তথ্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রক্রিয়া করে থাকে।
একজন সুস্থ মানুষ আর অন্যদিকে একজন হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি দুজনের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বা কর্ম প্রক্রিয়া কোনোটাই এক ভাবে কাজ করে না। যখন আমরা কোন ভালো খবর পাই তখন খুশি হই। আবার দুঃসংবাদ পেলে কষ্ট পাই। মস্তিষ্ক এরকম আগত তথ্যগুলো প্রক্রিয়া করে সে অনুযায়ী যথাযথ সাড়া দিয়ে আমাদের অনুভূতিগুলো জাগ্রত করে তোলে।
কিন্তু হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্মণের অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে দেখা যায় আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এসব মানুষের মস্তিষ্ক পক্ষপাত মূলক আচরণ করে। যার ফলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক তথ্যের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় তুলনামূলক নেতিবাচক তথ্য প্রক্রিয়াকরণে মস্তিষ্ক বেশি সাড়া দিচ্ছে।
অর্থাৎ ব্যক্তি যখন কোন ভালো সংবাদ পাচ্ছে সেটা তার মস্তিষ্ক সেভাবে প্রক্রিয়া করছে না বিধায় তার কাছে সেটা খুব ভালো কোন অনুভূতি দেয় না অন্যদিকে কোন দুঃসংবাদ পাওয়ার পর সেটা তাকে সেই তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট দেয়। মস্তিষ্ক কীভাবে এইক্ষেত্রে এরূপ পক্ষপাত মুলক আচরণ দেখায় এ নিয়ে এখন পর্যন্ত পূর্বে বিস্তর গবেষণা হয়ে এসেছে। যদিও এখনো এই TRD বা চিকিৎসা প্রতিরোধী হতাশা সম্পর্কে আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তরই অজানা।
তবে সম্প্রতি নতুন এক গবেষণা পরিচালনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বেইলর কলেজ অব মেডিসিন থেকে।
যেখানে Treatment Resistant depression (TRD) এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরীক্ষা চালানো হয়। গবেষণাপত্রটি Nature Mental Health এ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনা সামনে নেওয়ার পূর্বে কয়েকটি শব্দের সাথে পরিচিত হওয়া যাক :
Prefrontal Cortex (PFC)= মস্তিষ্কের একটি অংশ যা আমাদের আবেগ , চিন্তা, কাজ এসবের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
Amygdala = মস্তিষ্কে বাদাম আকৃতির একটি অংশ যা , ভয়, অনুপ্রেরণা ও আবেগের সাথে জড়িত।
Stereotactic electroencephalography signals (sEEG)= এটি এক ধরনের পরীক্ষা যা মস্তিষ্কের গবেষণায় প্রয়োগ করা হয় ,যেখানে মস্তিষ্কের ভেতর সূক্ষ্ম প্রোব প্রবেশ করিয়ে তড়িদ্দ্বার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের তড়িৎ কার্যক্ষমতা পর্যালোচনা করা হয়। পরিক্ষাটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের Prefrontal Cortex (PFC) ও Amygdala অংশগুলোতে sEEG পরিচালনা করা হয়।
আমাদের মস্তিষ্কে ইনফরমেশন প্রসেসিং, অর্থাৎ বাইরে থেকে আগত তথ্য প্রক্রিয়াকরণের দুটো ধরন রয়েছে:
১। Bottom up processing
২। Top-down processing
Bottom-up processing মস্তিস্কে যখন কোনো সংবেদনশীল তথ্য আসে তার অর্থবহ ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। আর Top-down processing মস্তিষ্কে পূর্বে থেকে জমা থাকা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে আগত সংবেদনশীল তথ্য ব্যাখ্যায় ভূমিকা পালন করে।
এখানে গবেষকরা মস্তিষ্কে উদ্দীপনা প্রক্রিয়া করার যে দুটো ধরণ রয়েছে ( Bottom up & Top-down processing) এই দুটি প্রক্রিয়ার উপর আলোকপাত করেন। উল্লেখ্য Amygdala এবং prefrontal cortex মস্তিষ্কে কোনো হুমকি বা বিপদের আঁচ পাওয়া এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়া করে, যা কিনা উল্লিখিত Bottom up ও Top down প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত হয়। যে-সব ব্যক্তির Treatment resistant depression নেই তাদের আবেগ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে এই দুইটি প্রক্রিয়া ভারসাম্যপূর্ণ ভাবেই কাজ করতে পারে।
আলোচ্য গবেষণায় উপরোল্লিখিত sEEG signal প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন TRD রোগীর amygdala ও PFC পরীক্ষা করা হয়, গবেষকরা লক্ষ্য করেন মস্তিষ্কের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উদ্দীপনাগুলো প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে Top down ও Bottom up processing এ ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট গবেষক ডক্টর কেলি বিজানিক বলেন,
“হতাশাগ্রস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করি দু:খ সংক্রান্ত উদ্দীপনায় তাদের amygdala অঞ্চলে বেশি সাড়া প্রদান হচ্ছে। অন্যদিকে সুখ সংক্রান্ত উদ্দীপনার প্রক্রিয়াকরণে Amygdala তে বাধা পরিলক্ষিত হচ্ছে বা দেরিতে সাড়া প্রদান করছে। এই ফলের প্রেক্ষিতে আমরা এখন এই রোগের নেপথ্যে মানুষের আবেগ প্রক্রিয়াকরণে স্নায়বীয় গতিবিধি সম্পর্কে এমন নতুন করে ধারণা লাভ করতে পেরেছি যা পূর্বে ছিল না।”
Deep brain stimulation (DBS) একটি অস্ত্রোপচার ধরনের চিকিৎসা যেখানে Brain pacemaker নামের একটি যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয় যেটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন নির্দিষ্ট অংশে তড়িৎ স্পন্দন পাঠায়। এতে দেখা যায় এটি ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশনের মাধ্যমে স্নায়বিক প্রক্রিয়াকরণের সময় Top-down প্রতিক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে সেটার পরিবর্তন ঘটিয়ে মানসিক উদ্দীপনা ও স্নায়বিক কার্যক্ষমতা পরিবর্তন করে স্বাভাবিক করে দিচ্ছে।
ফলাফল বলছে যে, ইতিবাচক-নেতিবাচক তথ্যের প্রক্রিয়ায় যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়, এই Deep brain stimulation (DBS) চিকিৎসার মাধ্যমে স্নায়বিক সাড়ায় পরিবর্তন ঘটিয়ে এর উপশম করা সম্ভব।প্রাথমিকভাবে পাওয়া এই সাফল্য থেকে আশা করা হচ্ছে TRD আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই DBS চিকিৎসা তাদের এরকম ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবেগের প্রক্রিয়াকরণে ভারসাম্যহীনতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারে।
ডক্টর বিজানিক সেরকমই আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন,
“আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে এই প্রাপ্তি আমাদের এই হতাশার রোগের মূলোৎপাটনে সহায়তা করবে , এবং হয়ত এর ভিত্তিতেই একটি কার্যকরী চিকিৎসারও সূচনা হবে।”
সাদ ইবনে ওমর / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: মেডিকেলএক্সপ্রেস, নিউরোসায়েন্সনিউজ, নেচার