বাঁশকে প্রায়ই 21 শতকের সবুজ ইস্পাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটি একটি উল্লেখযোগ্য এবং টেকসই নির্মাণ সামগ্রী যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রীর মাঝে অতুলনীয় স্থায়িত্ব ও শৈলীর কারণে বাঁশ বহুল ব্যবহৃত।
ঐতিহ্যগতভাবে, বাঁশ মাচা তৈরির জন্য বা দেয়াল, ছাদ এবং মেঝের কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি আধুনিক টেকসই ভবনগুলিতে বাঁশ একটি ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করছে। এর প্রধান উদাহরণ হলো ইন্দোনেশিয়ার বালির গ্রিন স্কুল, যেখানে বেশিরভাগ ভবনই বাঁশের তৈরি। এটি মূলত পরিবেশবান্ধব টেকসই নির্মাণকার্যের প্রতি অনুপ্রেরণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু এখন এই বাঁশের গুণাগুণ, স্থায়িত্ব ও ব্যবহারকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটি অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজির (CSUFT) এর একদল গবেষক। তারা প্রাকৃতিক বাঁশ ব্যবহার করে একটি অভিনব উপায়ে কাঁচের মতো স্বচ্ছ উপাদান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এই নতুন উপাদানটিতে একটি তিন-স্তরবিশিষ্ট শিখা-প্রতিরোধক রয়েছে,যা কার্যকরভাবে তাপ নিঃসরণ হ্রাস করে, শিখা ছড়িয়ে পরা ধীর করে দেয় এবং দাহ্য-উদ্বায়ী, বিষাক্ত ধোঁয়া এবং CO (কার্বন মনোক্সাইড) এর নির্গমনকে বাধা দেয়।
কাঁচের ক্ষেত্রে সিলিকা হচ্ছে প্রচলিত উপাদান। বছরের পর বছর ধরে, সিলিকা-ভিত্তিক কাচ বিভিন্ন সেক্টর জুড়ে ব্যবহার করা হয়েছে এবং 2020 সালে এর চাহিদা 130 মিলিয়ন টন ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এই পদ্ধতিতে কাচ তৈরি করা সহজ এবং সস্তা, তবে চূড়ান্ত পণ্যটি অত্যন্ত ভঙ্গুর, এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উদ্বায়ী ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে। তাই এটিকে পরিবেশবান্ধব বলা চলে না।
এর বিকল্প হিসেবে, স্বচ্ছ কাঠ সম্প্রতি তার পরিবেশগত সুবিধা এবং চমৎকার যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই স্বচ্ছ কাঠ শীঘ্রই স্মার্টফোনের জন্য সুপার-স্ট্রং স্ক্রিন হিসেবে বা বাসা বাড়ির জানালায় ব্যবহার করা যাবে। যাইহোক, বিশ্বব্যাপী কাঠের ঘাটতি, পলিমার সামগ্রীর কারণে জ্বলনযোগ্যতা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার জন্য এর কার্যকারিতা কিছুটা সীমিত।
CSUFT-এর কলেজ অফ ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষক কাইচাও ওয়ান ব্যাখ্যা করেছেন যে,
“বাঁশের বৃদ্ধি এবং পুনর্জন্মের হার বেশি, যার ফলে এটি পরিপক্কতায় পৌঁছাতে পারে এবং বৃদ্ধির চার থেকে সাত বছরের মধ্যে এটি স্থাপত্যে একটি ব্যবহারযোগ্য উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।”
বাঁশের গঠন কাঠের অনুরূপ। CSUFT টিম অজৈব সোডিয়াম সিলিকেটকে (Na2O·nSiO2) বাঁশের কাঠামোতে ঢোকানোর জন্য একটি ভ্যাকুয়াম-ইমপ্রেগনেশন কৌশল ব্যবহার করেছে। এই প্রক্রিয়াটি একটি তিন-স্তরযুক্ত শিখা-প্রতিরোধী বাঁধা তৈরি করে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাঁশের অগ্নি প্রতিরোধক ক্ষমতা এবং যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বাড়িয়ে তোলে।
ওয়ান বলেন,
“এই কৌশলটির মাধ্যমে, আমরা একটি ত্রিস্তরযুক্ত শিখা-প্রতিরোধী বাঁধা তৈরি করতে পারি যার মধ্যে একটি শীর্ষ সিলেন স্তর থাকবে, SiO2 এর একটি মধ্যবর্তী স্তর যা হাইড্রোলাইসিস-পৃষ্ঠে Na2SiO3 এর ঘনীভবনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে, এবং Na2SiO3 এর একটি অভ্যন্তরীণ স্তর গঠিত হয়।”
স্বচ্ছ বাঁশের চিত্তাকর্ষক কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন, কম তাপ উৎপন্ন করে, ক্ষতিকারক গ্যাস নিঃসরণ করে না, CO এর ঘনত্ব তুলনামূলক কম। তাদের পরীক্ষায়, গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে তাদের নতুন তৈরি করা উপাদানটির ইগনিশন সময় ছিল মাত্র 116 সেকেন্ড এবং মাত্র 0.7 MJ/m2 তাপ বেরোয়। উপাদান থেকে ধোঁয়া উৎপাদন 0.063 বর্গমিটার এরও কম ছিল। উপাদানের এই উচ্চতর ক্ষমতাগুলো আরও ভালো যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।
গবেষকরা পেরোভস্কাইট সৌর কোষ তৈরি করতে এই স্বচ্ছ উপাদান ব্যবহার করেছেন। গ্লাসটি 71.6 শতাংশ উচ্চ আলোর প্রতিসরণ দেখায়, যা শক্তি রূপান্তর দক্ষতায় 15.29 শতাংশের উন্নতি ঘটায়।গবেষকরা ধারণা করছেন ভবিষ্যতে যেখানে আমরা সবুজ শিখা-প্রতিরোধী কাচ এবং অপটিক্যাল ডিভাইস সহ বিভিন্ন কাজের জন্য এই স্বচ্ছ বাঁশ ব্যবহার করবো।
এই উন্নয়ন টেকসই এবং দক্ষ নির্মাণ উপকরণের জন্য নতুন পথ খুলে দিবে,যা বিশ্বব্যাপী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখবে। বর্তমানে ব্যবহৃত সাধারণ কাচ সহজে পচে না বা মাটির সাথে মিশে যায় না, ফলে যেখানে সেখানে ফেলে দিলে পরিবেশের নানারূপ ক্ষতি করতে পারে।
বাঁশ থেকে স্বচ্ছ কাচ উৎপাদন করা গেলে এই ক্ষতি অনেকাংশেই কমানো যাবে কারণ বাঁশ যেহেতু বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল তাই পরিবেশের জন্য এটি তুলনামূলক কম ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে হয়ত এমন হবে আমরা আমাদের থাকার জন্য বিল্ডিং তৈরি করলে সেখানে জানালা হিসেবে বাঁশ ব্যবহার করতে পারবো।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিজিক্স.অর্গ