প্রথম কৃষ্ণ গহ্বর (Black Hole) আবিষ্কারের পর থেকে শুরু করে এপর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আমাদের গ্যালাক্সি থেকে দূরবর্তী সকল গ্যালাক্সি ও ইন্টার গ্যালাক্টিক (আন্ত:গ্যালাক্সি) ফাঁকা স্থানে অসংখ্য ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করেছেন। তার মধ্যে কোনটির ভর সূর্যের কয়েক গুন থেকে সূর্যের সৌর ভরের তুলনায় কয়েক হাজার কোটি গুন পর্যন্ত বেশি।
তার মধ্যে সম্প্রতিই বিজ্ঞানীরা আমাদের গ্যালাক্সিতে সবচেয়ে বড় স্টেলার ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে যার ভর আমাদের সূর্যের তুলনায় প্রায় ৩৩ গুন। এবার তার থেকেও আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে নাসার একদল গবেষক। তাদের ধারণা মতে নাসার Nancy Grace Roman Space Telescope কম ভরের ব্ল্যাক হোল অনুসন্ধান করতে সক্ষম হতে পারে, যেসব এতদিন বিজ্ঞানীদের খোঁজের অন্তর্ভুক্তই ছিল না। ব্ল্যাক হোলের এই শ্রেণীকে ডাকা হচ্ছে ফেদারওয়েট নামে।
কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল কী?
কল্পনা করা যাক বাতাসে ভাসমান একটি চাদর যাতে কোন প্রকার ভাজ নেই। এখন এর মাঝে যদি একটি আপেল রাখা হয় তাহলে কি লক্ষ্য করা যায়? আপেলের ভারে চাদর তল কিছুটা নিচের দিকে বক্র হয়ে গেছে এবং আপেলের চারপাশেও গোল বক্র তল তৈরি হয়েছে। এখন একটি মার্বেল যদি এই বক্রতল বরাবর ছুঁড়ে দেয়া হয় তাহলে এটি মনে হবে আপেলকে আবর্তন করে ঘুরছে।
মূলত এভাবেই মহাকর্ষ বল কাজ করে। কাল্পনিক সে চাদর আমাদের স্পেস টাইম (Space-Time) ফেব্রিক আর আপেল কিংবা মার্বেল আমাদের গ্রহ-নক্ষত্র। স্পেস-টাইম ফেব্রিক হলো আইন্সটাইন প্রদত্ত একটি কাল্পনিক চাদর সদৃশ তল যেটি ছড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব জুড়ে আর আমাদের গ্রহ নক্ষত্র সহ সকল বস্তু এই তলের উপর অবস্থিত। গ্রহ নক্ষত্রের বিচরণ এবং মহাকর্ষ বল সকল কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই স্পেস-টাইম ফেব্রিক।
এখন, আবার সেই কাল্পনিক চাদরে ফিরে যাই। যদি আপেলের জায়গায় আরো ভারী কিছু রাখা হয় তাহলে বক্রতা আরো বৃদ্ধি পাবে। আর এভাবে যদি অসীম ভরে নিয়ে যাই তাহলে কাল্পনিক সেই চাদর দুমড়েমুচড়ে যাবে। ঠিক এভাবেই তৈরি হয় কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে মহাকর্ষ টান এতটাই শক্তিশালী হয় যে আলোক তরঙ্গও একে ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারে না। তৈরি হয় অন্ধকার বিভীষিকা।
বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা এসব ব্ল্যাক হোল কোনটি তৈরি হয়েছে মৃত কোন নক্ষত্রের বিস্ফোরণে, যাকে সুপারনোভা (Supernova) বলে। অথবা সাধারণ ধূলিকণা বা স্পেস ডাস্টের থেকে, যার কোনটির ভর এই সৌরজগৎ থেকেও বেশি আয়তনেও কয়েকগুণ। তবে ভরে অতি নগণ্য, হতে পারে পৃথিবীর সমান, এমন ব্ল্যাক হোল আমাদের মহাকাশ নিয়ে ধারণা বদলে দিতে পারে।
এ বিষয়ে ক্যালিফোর্নিয়া সেন্টা ক্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি রিসার্চার উইলিয়াম ডিরোকো বলেন,
”পৃথিবীর ভরের সমতুল্য একটি আদিম ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করা হতে পারে মহাকাশ গবেষণাকারী ও কণা পদার্থবিজ্ঞান(Particle Physics) এর জন্য যুগান্তকারী আবিষ্কার।”
তিনি আরো বলেন,
”যদি এমন কিছু আসলেই পাওয়া সম্ভব হয় তাহলে তা আমাদের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান (Theoretical Physics) এর ভিত্তি কাঁপিয়ে দিতে পারে।”
আকারে সবচেয়ে ছোট স্টেলার ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় সুপারনোভা থেকে। যখন অতিবৃহৎ কোন তারার জ্বালানি ফুরিয়ে যায় তখন তারকার পৃষ্ঠীয় মহাকর্ষীয় বলের চাপ সহ্য করতে না পেরে এটি সংকুচিত হতে থাকে অতঃপর হয় বিস্ফোরণের অবশিষ্ট অসীম ঘনত্বের মৃত তারা থেকে তৈরি হয় ব্ল্যাক হোল।
শর্ত মোতাবেক এমন বিস্ফোরণের জন্য সেই তারকাকে সূর্যের ভরের আট গুন হতে হবে। এর চেয়ে কম ভরের তারার মৃত্যুতে তা হয় নিউট্রন স্টার অথবা শ্বেত বামুন(White Dwarfs) এ পরিণত হয়। কিন্তু চিরায়ত বিজ্ঞানের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। প্রাচীন সদ্য সৃষ্ট মহাবিশ্ব হয়ত এই শর্তের চেয়ে কম ভরের ব্ল্যাক হোল সৃষ্টির সুযোগ করে দিতে পারে।
পৃথিবীর ভরের সমান ইভেন্ট হরাইজন (কৃষ্ণ গহ্বর এর মধ্য স্থান, যেখান থেকে কোন বস্তু ফিরে আসতে পারে না) তৈরি হতে পারে। আর এ জন্য দায়ী সেসময়ের মহাবিশ্বের অবস্থা। সদ্য সৃষ্ট মহাবিশ্বে সকল এনার্জি ও পার্টিকেল প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। আর এমন বিশেষ মুহূর্তে এমন অঞ্চল তৈরি হওয়া সম্ভব যার ভর অতি সামান্য হলেও ঘনত্ব এতটাই বেশি যে চারপাশে স্পেস টাইম দুমড়ে মুচড়ে তৈরি হয়েছে কোন অল্প ভরের ব্ল্যাক হোল।
যদিও তত্ত্ব মতে মহাবিশ্ব বর্তমান স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসলে এসব অল্প ভরের ব্ল্যাক হোল কর্পূরের মতো উবে গেছে কিন্তু পৃথিবীর কাছাকাছি ভরের ব্ল্যাকহোলগুলো এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এসব ক্ষুদ্র ব্ল্যাক হোলের আবিষ্কার অ্যাস্ট্রোনমি ও স্পেস সাইন্সের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
কৈলাস সাহু নামের একজন এস্ট্রোনমার বলেন,
”এসব ব্ল্যাক হোল গ্যালাক্সি তৈরি, মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটারের উৎপত্তি থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের ইতিহাসে প্রভাব ফেলতে পারে।”
এসব অতিক্ষুদ্র ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করতে হতে পারে। তবে এমন কিছু একটার আবিষ্কার যা চিরায়ত আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের চেহারা পাল্টে দেবে। এর পিছনে সময় ও শ্রম ব্যয় করার পর আবিষ্কার করা গেলে সেটি হবে পয়সা উসুল করা পরিশ্রম।
এস এম ইফতেখার আলম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নাসা, সায়েন্সস্প্রিংস